ভূপদার্থবিদ ড. মাইকেল স্টেকলার তার ২০১৬ সালের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ কীভাবে গাঙ্গেয় গঙ্গার বদ্বীপ এলাকার চেহারা বদলে দিয়েছিল। পৃথিবীর উপরিভাগের কতগুলো বিশাল অনমনীয় প্লেটকেই টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। এরা খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। কোনো কারণে প্লেটগুলোর নিজেদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হলেই সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।
পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। পৃথিবীর চেহারাই বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ভূমিকম্পের। তবে ভূমিকম্প যে নদীর গতিপথ বদলে দিতে পারে, এই প্রথম এর প্রমাণ পেলেন গবেষকরা। রাস্তার পাশে খোঁড়া গর্ত থেকে তারা প্রমাণ পেয়েছেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভূমিকম্পে বদলে গিয়েছিল গঙ্গার গতিপথ। গত ১৭ জুন ‘নেচার কমিউনিকেশন’ জার্নালে প্রকাশিত হয় এ গবেষণা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অববাহিকা হলো গঙ্গা নদীর অববাহিকা। হিমালয় পর্বত থেকে জন্ম নিয়ে ভারতের মাঝ দিয়ে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে গঙ্গা। সেই গঙ্গাই ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বিশ্বে আমাজন ও কঙ্গো নদীর পর গঙ্গাতেই সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয়।
‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ প্রকাশিত গবেষণাটির প্রধান গবেষক নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এলিজাবেথ চেম্বারলেন। তিনি সিএনএনকে বলেন, গাঙ্গেয় বদ্বীপ `কাজ করার জন্য সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চকর জায়গা`; কারণ এর গতিপথ বিশাল, বৈচিত্র্যময়। এ ছাড়া এ নদীর শাখাও অনেক।
ঢাকার দক্ষিণাংশে গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রায় ১০০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ জরিপ চালান চেম্বারলেন ও তার সহকর্মীরা। এ জরিপে তারা ব্যবহার করেন স্যাটেলাইট মানচিত্র ও ডিজিটাল এলিভেশন মডেল, যার মাধ্যমে নদীর আগের গতিপথের চিত্র দেখা যায়।
চেম্বারলেন বলেন, ‘নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করবে, বিষয়টি স্বাভাবিক। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টিকে আমরা অ্যাভালশন (ভ্রমণ) বলি।’
চেম্বারলেনের গবেষকদলটি মূলত গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার খোঁজেই অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধানে পলিমাটির কিছু নমুনা গঙ্গার প্রাচীন গতিপথের নাটকীয় পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
একদিন কাজ শেষে হোটেলে ফেরার পথে ঢাকার রাস্তার পাশে খুঁড়ে রাখা নতুন গর্ত দেখতে পান গবেষক দল। গর্তটি নতুন খোঁড়া হওয়ায় ওটার স্ট্র্যাটিগ্রাফি—অর্থাৎ গর্তের দেয়ালে পলিমাটির স্তর দেখতে পাচ্ছিলেন তারা। ওই স্তর দেখে তারা সঙ্গে সঙ্গে গর্তে নেমে যান বলে জানান চেম্বারলেন।
গর্তটিতে গাঢ় কালো রঙের মাটিতে ১০ ফুট উচ্চতার হালকা রঙের পলিমাটির কলাম (স্তম্ভ) দেখতে পান গবেষকরা। ভূমিকম্পের কারণে নদীর গতিপথ বদলানোর কারণেই এখানে গাঢ় রঙের মাটির সঙ্গে হালকা রঙের পলিমাটি মিশে রয়েছে।
যখন ভূমিকম্প হয়, নদীগর্ভে জমে থাকা হালকা পলিমাটি সরে গিয়ে নিচের এ গাঢ় কাদা ওপরে উঠে আসে আগ্নেয়গিরির উদগিরণের মতো।
চেম্বারলেন এ বিষয়ে বলেন, ভূমিকম্পের সময় যে কম্পন হয়, তাতে বালু ও কাদা জায়গা থেকে সরে যায়। আর বালু ও কাদার নড়াচড়া আলাদা। কাদা খুব আঠালো, পরস্পরের সঙ্গে খুব শক্তভাবের যুক্ত থাকে। অন্যদিকে বালুর স্তর হালকা হয়। বালুর কণা কিছুটা মুক্তভাবে নড়াচড়া করে, বিশেষ করে পানিতে থাকার সময়।
তাই ভূমিকম্পের সময় বালু বেশি নড়াচড়া করে, জায়গাও বেশি নেয়। আর কাদামাটি এ বালুকে চাপ দিলে ব্যাপক চাপের সৃষ্টি হয়। ওই চাপ অনেক বেশি হলে কাদামাটির নিচে থাকা বালু ঠেলে ওপরে চলে আসতে পারে। আর তাতেই সৃষ্টি হয় ‘বালুর আগ্নেয়গিরি’।
গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, এ বালুর আগ্নেয়গিরি গঠিত হয়েছে আড়াই হাজার বছর আগে, অর্থাৎ মাটির কণাগুলো ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরনো। চেম্বারলেন ও তার দল মাটির বয়স বের করার এ কাজ করেছেন ডার্করুমে, যাতে আলোর সংস্পর্শে এসে পলির নমুনা ‘দূষিত’ না হয়ে পড়ে।
ঢাকায় রাস্তার পাশের যে গর্তে বালির আগ্নেয়গিরি পাওয়া গেছে, সেখান থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরেও একটি বড় নদীর চ্যানেল পান বিজ্ঞানীরা। ওই নদী থেকে মাটির আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। পরীক্ষা করে দেখেন, সেগুলোও একই সময়ের মাটির কণা।
এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, আড়াই হাজার বছর আগে নদীটির গতিপথ নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল। এসব ঘটনার সময়কাল ও স্থান খুব কাছাকাছি। এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, আড়াই হাজার বছর আগে এক বড় মাত্রা ভূমিকম্পে বদলে গিয়েছিল গঙ্গার গতিপথ।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস-এর সিভিল ও পরিবেশ প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক ড. জনাথন স্টুয়ার্ট বলেন, ‘প্রকৌশলগত দিক থেকে, নদীর গতিপথের এ অস্থিতিশীলতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
গবেষণাটি বি🌱ভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য উপকারী বলে মন্তব্য করেন তিনি। কারণ বাংলাদেশে কত সময় পরপর বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে এবং আঘাত হানলে কোন অঞ্চলগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে বিষয়ে আরও অনেক তথ্য দিতে পারবে এ গবেষণা। সূত্র: সিএনএন, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা