বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আলোকোজ্জ্বল 𝔉নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী, সমাজ বিশ্লেষক।
বাংলা সাহিত্য সম্ভারের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের পদছায়া পড়েনি। রবীন্দ্রনাথ এমন এক মহিরুহ, যিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রায় সব লেখক-শিল্পীকে ছায়া প্রদান করেছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় থেকেই তারা লালিত-পালিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটা অভিধান। যে অভিধানের সমগ্রটাই তাঁর নিজের সৃষ্টি। শৈশব থেকেই জমিদারি পরিবারের কঠোর শাসন-শোষণে তিনি বেড়ে উঠেছেন। মাতৃহীন রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠা কতꦍটা ক🍒ষ্টে, তা তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়।
সাধারণ মানুষের ধারণা, রবীন্দ্রনাথ সোনার চামচ মুখে জন্মেছিলেন, ফলে শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাবে ঘটেছে। এমনটা কিঞ্চিৎ নয়। বরং তাঁর জীবনীগ্রন্থ পাঠে জানা যায়, শৈশবের একাকিত্ব, তাঁর নিঃসঙ্গতা, বিদ্যালয়ে শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি ব্যাপক অনীহা, বাড়ির দাস-দাসীদের সহযোগিতায় মানুষ হয়ে ওঠা একটি বালকের গল্প। রবীন্দ্রনাথ পুরো জীবনটাই এক দুঃখগাথা। তবু কোথাও♑ তাঁর হার মানার গল্প আমরা দেখি না। প্রতিনিয়ত সজীবতায় ঋদ্ধ করেছেন নিজেকে। বুকের গহিনে ‘বেদনার বালুচর’ থাকলেও তিনি পৃথিবীকে জয় করেছেন। তাঁর অদম্য শক্তি তাঁকে আকাশচুম্বী সাফল্য দিয়েছে।
শৈশবে যখন রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছেন, তখন বাড়ির বাইরে যাওয়া তাঁর জন্য সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। এমনকি অন্দরমহলের সব জায়গায় বিচরণের অধিকারও ছিল না। সেই রবির একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা তাঁকে প্রকৃতির অপরূপ মায়াময় পৃথিবীকে নতুনভাবে বুঝতে-জানতে শিখিয়েছে। পরবর্তীকালে একাকিত♋্বের শৃঙ্খল কাটে যখন তাঁরই সমবয়সী এক ছোট্ট বালিকা বিয়ে হয়ে জমিদার পরিবারে আসে। ছোট্ট রবির খেলার সঙ্গী, একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার উত্তম সঙ্গী তাঁর বড় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেব🎀ী। বড় দাদার স্ত্রী হলেও সমবয়সী হওয়ায় দুজনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এবং রবীন্দ্রনাথের লেখকসত্তার হাতে খড়িও ঘটে বউদির অনুপ্রেরণায়। রবীন্দ্রনাথ যখন ছোট ছোট কবিতা লিখে বউদিকে শোনাতেন, তখন কাদম্বরী দেবীর প্রিয় লেখক কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো হয়নি বলে আবারও তাঁকে অনুপ্রেরণা দিতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ বেড়ে ওঠেন। তবে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কবির বিবাহের পর কাদম্বরী দেবী নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এবং তিনি আত্মহত্যা করেন। যদিও তাঁর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। যদিও পাঠকমহলে নানা গুঞ্জন শোনা যায়! ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। বউদির চেয়ে রবীন্দ্রনাথের বাল্যসখাই তিনি ছিলেন বেশি! সেই বন্ধুর মৃত্যুর পর রবির জীবনে আঘাত লাগলেও সে আঘাতের চিহ্ন তিনি কোথাও রাখেননি। বরং নিজেকে আরও ভেঙেচুরে গড়েছেন। বউদির চাওয়াকে পূর্ণতা দিতে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে একের পর এক চারা রোপণ করেছেন। যার সুমিষ্ট ফল আজও বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা ভোগ করছেন।
১৮৮৪ সালের ধাক্কাই রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ কথা নয়। বরং এরপর একের পর এক রবির জীবনে মেঘ ঘনিয়ে আসে। কালো মেঘের তর্জন-গর্জনে রবির জীবন অন্ধকার হয়ে আসার জোগাড় হয়। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ১৯০২-১৯০৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ খুব ঘনিষ্ঠজনদের মৃত্যু দেখেছেন। তাঁর অতি আদরের সন্তা✱নদের হারিয়েছেন। এই শোক কোনো সাধারণ মানুষের জন্য সইবার নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মহিরুহ। ফলে তাঁর গায়ে যতই আঘাত লাগুক, তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পারেন না।🐼 তাই তো তিনি লিখেছেন—
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।’
রবীন্দ্রনাথ জানতেন মানবজীবন দুঃখ-কষ্ট নিয়েই। ফলে জীবনে যতই কষ্ট আসুক, দুঃখ আসুক, তাঁকে পথ চলতেই হবে। হৃদয়ের কষ্টকে তিনি পথের কাঁটা করেননি। বরং তিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের সঙ্গে লড়েছেন বলেই রবীন্দ্রনাথ। তিনি আবার লিখেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, 🐼তবে একলা চলো রে।’
রবীন্দ্রনাথ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন এ পৃথিবীর যাত্রাটাই এমন। পাশে কেউ থাকে না। তাকে নিজ শক্তিতে চলতে হয়। সবাই ছেড়ে🎃 চলে গেলেও একলা চলতেই হবে। তাই তো এত মৃত্যুর মিছিলেও তিনি তলিয়ে যাননি। আক্ষেপ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, ‘ওগো নদী, আপন 𒉰বেগে পাগল-পারা, আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা/ আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি, আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারায়।’
ঠিক তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনে আক্ষেপের কোনোই স্থান নেই। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে প্রশান্তি খুঁজেছেন। সৃষ্টি𒀰সম্ভারের মধ্যেই বলে দিয়েছেন তিনি নদীর মতো পাগলপারা। সদাই তিনি অচল, গভীর চলাও তিনি গোপন রাখেন। তাঁর চলা কখনো থামেনি। তিনি থমকে যাননি। বরং নবীন পা🅰তায় নতুন করে স্বপ্ন বুনেছেন।
তার প্রমাণ মেলে যখন তাঁর আপনজনেরা এক-এক করে ছেড়ে যাচ্ছে, তখন তিনি এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গো-পালনবিদ্যা শেখার জন্য। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্র🧸নাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র ও জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়। এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না ও পুরীর বসতবাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ইতোমধ্যে অবশ্য বাংলা ও বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথে♊র ক♔বিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ আবারও নতুনভাবে নিজের চলার পথ প্রসারিত করেন।
রবীন্দ্রনাথ জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে তাঁকে অনেক অপমান-জ্বলা সহ𓆉্য করতে হয়েছে। তাঁর বড় কন্যা বেলার স্বামী শরৎকুমার চক্রবর্তী খুবই বর্বর ধরনের লোক ছিলেন। মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন বিধায় জামাইয়ের অসভ্য আচরণকে অগ্রাহ্য করেই কবি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। ‘🦹এক দিন দেখতে গেছেন বেলাকে কিন্তু মাঝপথে শুনলেন বেলা যক্ষ্মারোগে মারা গেছে। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি আর ওপরে উঠলেন না। মেয়ের শেষ মুখটি না দেখে ফিরে এলেন বাড়িতে। তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন বাড়িতে এসে তাঁর মুখে কোনো শোকের ছায়া নেই। কাউকে বুঝতে দিলেন না, কী অসহ্য বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন!’
বড় জামাই শরৎকুমার চক্রবর্তী,🌞 বিয়ের সময় তার বয়স ৩১ বছর। তিনি শ্বশুরমশাইয়ের চেয়ে নয় বছরের ছোট, শাশুড়ি মৃণালিনী দেবীর চেয়ে চা𒉰র বছরের বড়। আর স্ত্রী বেলার সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ১৬ বছর। এই বিয়েতে পণ দাবি করা হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। শেষতক রফা হয়েছিল ১০ হাজার টাকায়। তবে শর্ত ছিল, বিবাহের অন্তত তিন দিন আগে এই টাকা দিয়ে দিতে হবে। পাত্রীর তুলনায় তেমন সুদর্শন ছিলেন না পাত্র। কুলশীল বিচারেও সমান ছিলেন না। তবু রবীন্দ্রনাথকে পাহাড় ডিঙাতে হয়েছে। তবু তিনি হার মানবার নয়। জীবনকে নব আলোকে সাজিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম। নিজ লক্ষে তিনি অবিচল থেকেছেন। কোথাও তাঁর আক্ষেপ নেই। কারণ তিনি জানতেন,
না থাকে অন্ধকার,
না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোক `পরিতাপ,
হৃদয় বিমল হোক,
প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি,
বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি,
বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি।