প্রবাসীদের অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কানাডা ক🦂েমন দেখছি? আমি বলি, দেখার আর সময় পাচ্ছি কোথায়? ভোর থেকে রাত তো উৎসবেই কেটে যাচ্ছে। তবে উৎসবের ভেতর দিয়েও স্থান ও কালের পরিচয় পাওয়া যায়। টরন্টোতে এই উৎসব কি শুদ্ধ কিছু চলচ্চিত্র দেখানো মাত্র? কিছু সেমিনার আর টিকিট বেচাবিক্রি? বিষয়টি অত সরল নয়, জটিলও নয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভালো চলচ্চিত্রগুলোকে একত্র করে মানুষকে দেখার সুযোগ করে দেয় উৎসব। বর্তমান বিশ্বে যারা টিকটক, রিল ও ওয়াচে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ দেখেই যারা আহ্লাদিত হন, তাদের আবারও চলচ্চিত্রের সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করে উৎসব। আর সর্বোপরি একটি শহরের অর্থনৈতিক চাকাকে বেগবান করে দেয় একটি ভালো মানের আন্তর্জাতিক উৎসব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা ও কিছু স্থায়ী অবকাঠামো। বিশ্বজুড়ে শহরের নামটাও ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাও হয়। এসব ভাবনা আছে বলেই টরন্টোতে টিফের নিজস্ব ভবন হয়েছে। এবং সারা বছর সেখানে বিবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। আফসোস, আমাদের দেশে এখনো একটি জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
আজ টিফের নবম দিন। সকাল সকাল আবারও দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি। এবার একেবারে ক্রাইম অ্যাকশন এপিক, কোরিয়ার বক্স অফিস হিট করা পরিচালক রাইয়ু সেয়ুং-ওয়ান পরিচালিত ‘স্মাগলার্স’। সত্তরের দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার সাগরপাড়ের জেলেরা বিপদে পড়ে। বিশেষ করে নতুন কলকারখানার জন্য সামুদ্রিক প্রাণী সব মারা যাচ্ছিল। আগে নারীদের দল অগভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে আনত। কিন্তু কারখানার বর্জ্যের কারণে সব ঝিনুক মারা যাচ্ছে। এতে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। তখন তারা বাধ্য হয় চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত। এক জাহাজ নির্দিষ্ট জায়গায় চোরাই মাল ফেলে যায়, এই নারী ডুবুরিরা সেটা কুড়িয়ে ট্রলারে তুলে জায়গামতো পৌঁছে দেয়। রাতারাতি ধনী হয়ে যায় তারা। প্রশাসনের নজর পড়ে তাদের ওপর। শুরু হয় চোর-পুলিশ খেলা। এভাবেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত, পক্ষ-প্রতিপক্ষ ও টানটান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে ছবি অগ্রসর হয়। শেষতক নারী শক্তির জয় হয় এখানে। সব দুষ্টুকে দম করে টিকে থাকে সেই নারী ডুবুরিদের দল। তারা যখন ডুবসাঁতার দেয়, তখন তাদের জলপরীর মতো লাগে। অসাধারণ ভিজ্যুয়াল সৃষ্টি করেছেন পরিচালক। বাণিজ্যিক ঘরানার সব উপাদানই ছবিতে রয়েছে। আর্ট হাউস মুভির চেয়ে এ রকম মারদাঙ্গা ছবির দর্শকই বেশি। ছবিটি দক্ষিণ কোরিয়ায় যে ব্যবসাসফল হতে যাচ্ছে, তাতে আমি নিঃসন্দেহ।
জেলেপাড়ার চোরাকারবার থেকে পরবর্তী গন্তব্য আরব বেদুইনদের উটদৌড় প্রতিযোগিতা। মাঝে স্কশিয়াব্যাংকের ক্যাফেতে একটু বসে সময় কাটিয়ে মিসরীয়-অস্ট্রিয়ান পরিচালক আবু বকর শাওকির ছবি ‘হাজান’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকলাম। শুরু হলো ছবি। আরব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে উট ও শিশু জকিদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের গল্প বলতে থাকে ছবিটি। আরব বিত্তবান বেদুইনরা উট প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে। মাতর তেমনই এক কিশোর। মাতর ও তার উট হোফায়রাকে কিনে নেয় জাসের বলে এক শঠ লোক। মাতরের প্রিয় উট হোফায়রা। শিশুকাল থেকেই হোফায়রা বড় হয়েছে মাতরের সঙ্গে। মানুষ ও প্রাণীর এই সম্পর্কের সমান্তরালে এই ছবি নারীর ক্ষমতায়নের গল্পটাও বলেছে। সৌদি আরবের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিতে দেখা যায়, এক রহস্যবালক যে প্রায় প্রতি প্রতিযোগিতায় স্থান অধিকার করে, সেই রহস্যবালক আর কেউ নয়, এক কিশোরী। এবং তাকে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান অধিকার করতে দিয়ে মাতর তাদের মালিক জাসেরকে শায়েস্তা করে। কারণ, এই লোভী ও নির্বোধ জাসেরের নির্দেশেই মাতরের বড় ভাই উটদৌড়ের সময় মারা যায়। তা ছাড়া বেদুইন সমাজে উট দৌড়ে মেয়ে জকি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। প্রতিযোগিতায় লুকিয়ে মেয়ে জকি ব্যবহার করার দায়ে জাসেরকে আজীবনের জন্য প্রতিযোগিতা থেকে বহিষ্কার করা হয়। উদ্দেশ্য সফল হয় মাতরের। ছবির শেষবেলায় মাতর যে নিজে থেমে গিয়ে কিশোরী মেয়েটিকে প্রথম করে দিল, তার ভেতর দিয়ে মাতর হয় তো খলনায়ক জাসেরকে শাস্তি দিয়েছে, কিন্তু পরিচালক একটা শিক্ষা দিয়েছে সেই সমাজকে, যে সমাজ নারীদের গাড়ি চালাতে নিষেধ করে, ফুটবল মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে বারণ করে, রাস্তায় সাইকেল চালাতে মানা করে ইতি ও আদি।
‘হাজান’ ছবিতে মাতরের ভূমিকায় অভিনয় করা ছেলেটি কোনো অভিনেতা নয়, সে সত্যিই জকি হিসেবে কাজ করে। ওর আসল নাম ওমর আলআতোয়ি। ওকে দিয়ে অভিনয় করানোর পুরো কৃতিত্ব পরিচালকের। আর খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন আরব টেলিভিশনের পরিচিত ও জনপ্রিয় অভিনেতা আবদেল মোহসেন আল নেমার। তিনি টিফে এই ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন। দর্শকের করতালিতে সিক্ত হয়ে অভিনেতা মোহসেন শুধু বলেন, তিনি আপ্লুত, দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি নির্বাক। ছবির অভিনয় ও পরিচালনার পাশাপাশি প্রোডাকশন ডিজাইনও ছিল চমৎকার। পশ্চিম এশীয় মরুভূমির এই ওয়েস্টার্ন ছবিটি আমার মন্দ লাগেনি। ছবির কিছু অংশের শুটিং জর্ডানেও হয়েছে বলে জানান ছবির একজন প্রযোজক মোহাম্মদ হেফজি। তিনিও ছবির শেষে মঞ্চে এসে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, একজন আরব হিসেবে উটকে তাদের ভালোভাবে জানার কথা, কিন্তু সেটা তারা জানেন না। এটা নিয়ে তিনি আক্ষেপ করলেন। আরব সংস্কৃতিতে উটকে বিবেচনা করা হয় পবিত্র প্রাণী হিসেবে। শুধু কি তাই? উট তো আরব সাহিত্যেও বিশাল জায়গা নিয়ে আছে। যাহোক, ‘হাজান’ উটের প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগাবে কি না জানি না, তবে এটি আরব রাষ্ট্রগুলোর নারীবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে একটি বার্তা দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মরুর তপ্ত বালু থেকে এবার গিয়ে পড়লাম স্বর্গের হ্রদে জমাটবাঁধা বরফের রাজ্যে। স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটারে দেখতে বসলাম সিঙ্গাপুরের পরিচালক অ্যান্থনি চেনের ‘দ্য ব্রেকিং আইস’। উত্তর কোরিয়ার সীমান্তবর্তী চীনের ইয়ানজি প্রদেশে তিন তরুণ-তরুণীর পরিণতিহীন অদ্ভুত ত্রিভুজ প্রেমের এক আখ্যান এই ছবি। পড়ালেখা জানা ধনী তরুণ হাওফেং প্রচণ্ড হতাশায় ডুবে ছিল। সে একা একা বেড়াতে যায় চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ইয়ানজিতে। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আকর্ষণীয় তরুণী নানার সঙ্গে। নানা ছোটবেলায় আইস স্কেটিং করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তা নিয়ে দুঃখবোধ আছে নানার। তার কাছের বন্ধু শিয়াও, শহরেই তাদের রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে সে সহযোগিতা করে আর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ে বেড়ায়, কিন্তু লেখাপড়া সে বেশি দূর করেনি। এটা নিয়ে তারও হীনম্মন্যতা আছে। নানা কাছে টানে হাওফেংকে, তাই সে বন্ধু হয়ে ওঠে শিয়াওর। কিন্তু যখন শিয়াও বুঝতে পারে নানা ও হাওফেং বিছানা ভাগাভাগি করেছে, তখন সে ছিটকে পড়ে ত্রিভুজ থেকে। হাওফেং সাংহাই ফেরার প্রস্তুতি নেয়। নানাও সিদ্ধান্ত নেয় বহুদিন পর বাড়ি ফেরার।
মাঝে তারা চ্যাংবাই পর্বতে যায় হেভেন লেক দেখার জন্য। অপার্থিব সৌন্দর্য সেখানে হৃৎস্পন্দনকে থামিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু বরফের নিচে চাপা পড়া মাটি-জল-ঘাসের কথা কাউকে জানতে দেয় না। ঠিক যেন এই ত্রয়ীর মতো। তাদের তারুণ্যের সৌন্দর্য চোখধাঁধানো, কিন্তু তাদের ভেতরকার না-পারা, হতাশা আর অস্থিরতা দেখার কেউ নেই। তারা যেন সীমান্তের কাঁটাতারে বন্দী। সমান্তরালে আমরা দেখি পুলিশ এক আসামিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, চলছে চিরুনি অভিযান। অথচ এই তরুণরা যে তিলে তিলে আত্মিক মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেই খবর কেউ রাখছে না। বাইরে তারা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে পার্টি করছে, ঘুরতে যাচ্ছে, খাওয়াদাওয়া করছে, মনখোলা দিনযাপন করছে, কিন্তু হৃদয়ের করুণ সুর আর কয়জন শুনতে পায়? ছবির এক জায়গায় শিয়াও গিটার বাজিয়ে গান করে। হাওফেংয়ের মন আর্দ্র হয়, অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে নানার চোখ থেকে।
ছবিটি দেখতে দেখতে আমার ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফোর ‘জুল অ্যা জিম’ ছবিটির কথা মনে পড়ছিল। পর্বতে আরিরাং নিয়ে গান গাওয়ার সময় মনে পড়ছিল কিম কি দুকের ‘আরিরাং’ ছবিটার কথা। স্ক্রিনিং শেষে পরিচালক অ্যান্থনি চেন মঞ্চে এসে কথা বলেন। তিনি জানালের করোনা মহামারির সময় দুই বছর তিনি কিছুই করতে পারেননি। শুধু ভেবেছেন আর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছিলেন। সেখান থেকেই এই ছবির বীজ রোপিত হয়। কিম কি দুকের ‘আরিরাং’ ছবিটাও স্বয়ং পরিচালকের হতাশার গল্প এবং তার ফিরে আসার গল্পই বলে। মঞ্চের কথা শেষ হলে আমি এগিয়ে গিয়ে চমৎকার ছবিটির জন্য অ্যান্থনিকে ধন্যবাদ জানাই, আর বলি আমার কিম কি দুকের কথা মনে পড়ার কথা। তিনি বলেন, ছবিটি করার আগে তিনি ইনারিতুর ছবি ‘রেভেন্যান্ট’ দেখেছেন বারবার। আর ত্রুফোর ‘জুল আ জিমে’র সাথে ধারণাগত মিল থাকার কথাও তিনি স্বীকার করেন। তবে ভাঙা বরফের ছবি নতুন সময়ে পুনর্নির্মিত ফরাসি নুভেলভাগ এটা বলতেই হবে। ছবিটি হতাশা থেকে কিছুটা জেগে ওঠার কথা বলে। ভাঙা বরফ যেমন পুরোপুরি ডুবে যায় না, আবার ভেসেও ওঠে না সে রকম। তিন ভাঙা বরফের টুকরো নিয়েই ‘দ্য ব্রেকিং আইসে’র গল্প।
ছবি দেখে বেরিয়ে এসে সেই চেনা রাস্তা, চেনা পথ, কিন্তু অচেনা সব মুখেদের ভিড়। আর একটা ঘ্রাণ খুব চেনা হয়ে গেছে, সেটি হলো গাঁজার ঘ্রাণ। এখানে গঞ্জিকা সেবনে আইনি বাধা না থাকায় রাস্তায় চলাচলে প্রায়ই আপনার নাকে এসে গাঁজার গন্ধ হানা দেবে। তবে টরন্টোর তাজা বাতাস সেটাকে সরিয়ে দেয়। রাতে ফেরার সময় আমার সঙ্গে ফেরে পুরো টরন্টো। সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে তারা ট্রেনে চড়ে। তাদের ভেতর﷽ আনন্দআশ্রমটা বোধ হয় আটকে গেছে বরফের ভেতর। উষ্ণতাটুকু আর নেই চোখেমুখে। প্রাণের উত্তাপ হারিয়ে সবাই কেমন যেন চাবি দেওয়া পুতুলের মতো পাতালরেলে চড়ছে, নামছে, চড়ছে, নামছে। জীবন-জীবিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ মনে হয় একসময় দম দেওয়া যন্ত্রই বনে যায়।