• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


শিল্পের সিন্দুক : ১০

রশিদ চৌধুরী : একজন অনন্য শিল্পীর প্রতিকৃতি


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩, ০৫:২৫ পিএম
রশিদ চৌধুরী : একজন অনন্য শিল্পীর প্রতিকৃতি
প্রয়াত শিল্পী রশিদ চৌধুরীর আঁকা তাপিশ্রী শিল্পকর্ম। ছবি-ইন্টারনেট

বন্ধুরা, তোমাদেরকে আজ বাংলাদেশের এক অনন্য শিল্পীর গল্প শোনাব। তাঁর নাম রশিদ চৌধুরী। তোমাদের কেউ কেউ হয়তো তাঁর নামꦛ শুনে থাকতে পারো, তবে অধিকাংশের না শোনারই কথা। কেননা তিনি আমাদের শিল্পজগতের অন্যান্য দিকপাল যেমন জয়নুল, কামরুল কিংবা সুলতানের মতো ঠিক অতটা জনপ্রিয় নন। যদিও মেধা, প্রতিভা, অর্জন ও অবদানের দিক থেকে তিনিও কোনো অংশে কম নন। তিনি একদিক থেকে এঁদের সবার চেয়ে আলাদাও বটে, কেননা তিনি আমাদের শিল্পচর্চায় সম্পূর্ণ নতুন একটি মাধ্যমেরই প্রবর্তন করেছিলেন, যার নাম ট্যাপেস্ট্রি। তিনি এর একটি সুন্দর বাংলা নামও দি🍒য়েছিলেন—তাপিশ্রী! এটি আর কিছু নয়, পাট কিংবা চটের গায়ে সুতা, উল, রেশম ইত্যাদি দিয়ে নানারকম ছবি বোনা, ঠিক যেভাবে আমাদের তাঁতিরা তাঁদের তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে কাপড়ের গায়ে নানারকম নকশা করে থাকেন। তোমরা জেনে অবাক হবে, তিনি কিন্তু এই বিশেষ পদ্ধতিতে পাটের পটভূমিতে ছবি বুননের কাজটি শিখে এসেছিলেন সুদূর ফ্রান্স থেকে।

রশিদ চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় একটি অভিজাত পরিবারে। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেশ কৌতূহলী ও কল্পনাপ্রবণ স্বভাবের। বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ ছিল না তাঁর। আগ্রহ ছিল গ্রামের প্রকৃতি, মানুষজন, যাত꧒্রাপালা, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, নাটক, সার্কাস এসবের প্রতি। অভিভাবকেরা তাই তাঁকে পড়াশোনার জন্য একপর্যায়ে কলকাতা পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এইসব করে কোনোমতে বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তিনি যেখানে তাঁর প্রাণের টান, সেই ঢাকা আর্ট কলেজেই ভর্তি হয়ে যান ১৯৫০ সালে। কৃতিত্বের সঙ্গেই সেখানকার পড়াশোনা শেষ করে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এর কিছ🌱ুদিন পরই ১৯৫৬ সালে একবছরের জন্য বৃত্তি নিয়ে চলে যান স্পেনে। সেখানে রাজধানী মাদ্রিদ শহরের বিখ্যাত সেন্ত্রাল এস্কুয়েলা দে বেইয়াস আর্তেস দে সান ফের্নান্দোতে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। 

দেশে ফিরে আসার পথে লন্ডন 🉐ও প্যারিসের জাদুঘরগুলোও দেখে আসেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দেশে ফিরে তাঁর প্রাক্তন বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতায় যোগ দেন। কিন্তু কয়েকবছরের মধ্যেই ১৯৬০ সালে আবারও ফ্রান্স সরকারের বৃত্তি নিয়ে চলে যান তাঁর স্বপ্নের শহর প্যারিসে। এবার পুরো চার বছরের জন্য।

মূলত সেখানেই তাঁর তাপিশ্রীতে হাতেখড়ি হয়। ফ্রান্সের বিখ্যাত বনেদি আর্ট স্কুল আকাদেমি জুলিয়ঁ দে বোজার্ট এ পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি প্রখ্যাত শিল্পীদের কাছে হাতেকলমে কাজ🌠 শেখেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আধুনিক তাপিশ্রীর জনক জঁ ল্যুর্সার সঙ্গে, যাঁর শিল্পকর্ম ও শিল্পভাবনা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি তাপিশ্রীকেই তাঁর শিল্পচর্চার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। কেননা তাপিশ্রী মূলত একটি ইউরোপীয় শিল্পমাধ্যম হলেও তিনি এর সঙ্গে বাংলার পাট ও তাঁতের আত্মীয়তা খুঁজে পান এবং এর মধ্যে একটি নতুন স্বদেশী শিল্পমাধ্যম আবিষ্কারের অপার সম্ভাবনা দেখতে পান। তো, সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণী ভাস্কর আনি গ্রঁজিয়েরের সঙ্গে। পরে তাঁদের বিয়ে হয় এবং তাঁরা দুই জমজ কন্যার জন্ম দেন, যাদের নাম রাখা হয় রশিদ ও আনির দুই মাতামহীর নাম অনুসারে, শিরিন ও তেরেস। 

প্যারিসের পাট চুকিয়ে তাঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন ১৯৬৫ সালে এবং রশিদ চৌধুরী তাঁর প্রাক্তন প্রতিষ্ঠান ঢাকা আর্ট কলেজের প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে যখন দেশে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে চারুকলা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ক্রমান্বয়ে সেখানে স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে স্নাতক পর্যায়🐠ে চারুকলা শিক♛্ষার সূচনা করেন। এই বিভাগটিকে গড়ে তোলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে আরও একটি উচ্চমাধ্যমিক শিল্পকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। 

১৯৭৭ সালে চারুকলায়, মূলত তাপিশ্রী শিল্পে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চারুকলা বিষয়ে একুশে 🦂পদকবিজয়ী তিন🐎িই সর্বপ্রথম চিত্রশিল্পী।

শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব শিল্পচর্চাও অব্যাহত ছিল। দেশেবিদেশে তাঁর প্রচুর একক ও দলীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেটি আরও বেগবান হয় ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার পর। ঢাকায় এসে তিনি প্🦩রথমেই মিরপুরে বাংলাদেশের প্রথম তাপিশ্রী কারখানা স্থাপন করেন। শুরু করেন একের পর এক বিশালাকার সব তাপিশ্রী নির্মাণ; তাপিশ্রী উপকরণ যেমন সুতার পাশাপাশি রেশমের ব্যবহার নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাঁর এই কাজগুলো দেশে ও বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় স্থান পায়। 

দেশে তাঁর বিখ্যাত তাপিশ্রীগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় ‘আমার সোনার বাংলা’র কথা, যেটি রয়েছে আমাদের মহান জাতীয় সংসদ ভবনের অভ্যন্তরে। সেখানে তাঁর আরও কয়েকটি তাপিশ্রীও সগৌরবে বিরাজমান। এর বাইরে,  বঙ্গভবন, গণভবন, জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহেও রয়েছে তাঁর অনেক আকর্ষণীয় শিল্পকর্ম। আর বিদেশে তাঁর তাপিশ্রীর উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্য🃏ে রয়েছে, ফ্রান্সের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়, ভা✃রতের জাতীয় জাদুঘর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের মহাসচিবের কার্যালয়, মিশরের রাষ্ট্রপতি ভবন, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি ভবন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন, অস্ট্রেলিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ভবন, মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ভবন, ফরাসি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ব্যাংক, জেদ্দা ইত্যাদি। 

২০২০ সালে নিউ ইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত মেট্রোপলিটান মিউজিয়ম অব আর্টে তাঁর তিন তিনটি তাপিশ্রী প্রদর্শিত হয়েছে, যার মধ্যে একটি শিল্পকর্মকে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাঁদের স্থায়ী সংগ্রহশালা🅘য় অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যা জাদুঘরের ইতিহাসে সংগৃহীত প্রথম কোনো বাংলাদেশি শিল্পীর কাজ। এটি চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু।

রশিদ চৌধুরী চিত্রকলার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও কꦡরতেন। ষাটের দশকের 💯শেষদিকে ঢাকায় তরুণ কবি-প্রকৌশলী-স্থপতিরা মিলে ‘না’ নামে যে একটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল, তিনি তার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এছাড়া মূল ফরাসি থেকে সমকালীন ফরাসি কবিদের অনেক কবিতাও তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। ;

রশিদ চৌধুরী ছিলেন একজন প্রচওণ্ডরকম স্বাপಌ্নিক মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে একটি শিল্পীচত্বর প্রতিষ্ঠার। তিনি এমনকি শ্রীপুরে একটি সম্পূর্ণ তাপিশ্রীগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্যও অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আচমকা মৃত্যু এসে তাঁর সব শিল্পস্বপ্নকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল। 

মাদ্রিদে থাকাকালেই রশিদ চৌধুরী একবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের দিকে তিনি আবার ফুসফুসের কꩲ্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার ধকল তিনি আর সইতে পারেননি। দেশে-বিদেশে নানারকম চিকিৎসার পরও তিনি অবশেষে ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।তবু সান্ত্বনা, মৃত্যুর ঠিক আগের বছরটিতেই, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় 💙তাঁর বড়সড় একটি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। 

রশিদ চৌধুরী শুধু বাংলাদেশে নয় গোটা উপমহাদেশেই আধুনিক তাপিশ্রী শিল্পের একজন পথিকৃৎ ও অগ্রগণ্য শিল্পী। আমার জানামতে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মাত্র একজন শিল্পিই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে, গভীর নিষ্ঠা ও নিবেদনের সঙ্গে রশিদ চৌধুরীর সৃষ্ট এই সুন্দর, স্বতন্ত্র  ও দেশজ শিল্পমাধ্যমটিতে কাজ করꦉে চলেছেন; তিনি হচ্ছেন প্রবাসী শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন। এই মহান শিল্পীর প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধাঞ্জলি হবে চন্দনের মতো আরও অনেক সৃষ্টিশীল তরুণকে যদি আমরা তাপিশ্রী চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি। আর এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে প্রয়াত রশিদ চৌধুরীর সেই তাপিশ্রীপল্লী প্রতিষ্ঠার স্বপ্নটিকে যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। আমি আমার এই সামান্য লেখাটির মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে আমাদের রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

Link copied!