‘বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের বেদনা যেমন এক, আগ্রহ যেমন এক, উদ্দীপনা যেমন এক, তেমনি করে ভালবাসার রঙও তো গোটা পৃথিবীতে একই।’ শুক্রবার সন্ধ্যায় রংপুরে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে কোরিয়া 🌺ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় একথা বলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা। দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যের একত্মতার এই জায়গা ধরেই আলোচনা করেন ‘সাহিত্যে ঐতিহ্য-প🍃রম্পরা: কোরীয় ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক সেমিনারের আলোচকরা।
আলোচনায় বিশ্বসাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রাবন্ধিক সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, ‘নানা দেশের নানা ভাষার কথাসাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, চিত্রকর, চলচ্চিত্র নির্মাতা-- এরা সবাই তাদের অন্তর্গত স্বভাবের কারণেই শোষণের বিপক্ষে এবং শোষিতের পক্ষে অবস্থান নেন। তাদের এই অবস্থান যেকোনো দেশের শোষিত মানুষের পক্ষেই অবস্থান এবং এই মানুষগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা হয়ে ওঠে।’
‘সাহিত্যে ঐতিহ্য-পরম্পরা: কোরীয় ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক এই আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক গৌরাঙ্গ মোহান্ত। কোরিয়ার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ও রাজনীতির নানা বাঁক পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন তাঁর প্রবন্ধে। দক্ষিণ কোর༺িয়ার কবি ও কথাসাহিত্যিকদের রচনার রীতি ও প্রকরণ নিয়েও বিশেষভাবে আলোচনা করেন তিনি।
আলোচনায় বিশশ⭕তকের কোরিয়ার সাহিত্য এবং বাংলাসাহিত্যের কবিদের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে যে সাজুয্য রয়েছে তা তুলে ধরেন কবি ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আতাহার আলী খান।
সেমিনারে প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক অধ্যাপক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য বিশ্বসাহিত্য পাঠ ও অনুবাদের প্রয়োজনের দিকগুলো নিয়ে কথা বলেন। অনুবাদের সংকটের দিকগুলো তুলে ধরে বলেন, ‘ইতালীয় প্রবাদে বলা হয়, অনুবাদ হলো এম্ব্রয়ডারির উল্টো পিঠের মতো। অনুবাদে মূল নকশা✅র অনেক সৌন্দর্য অনেক সময় হারায় বটে, তবে এর কোনো বিকল্পও নেই।’ কোরিয়ার পঞ্চদশ শতকের কবি সান সুনের কবিতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোরিয়ার কবিতা অনেক সহজ, অনায়াস ও আড়ম্বরহীন। কোরিয়ার কবিতার এই বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য আমাদের বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের মতোই।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. আলী রায়হান সরকার কোরিয়ার জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং কে-পপ ও কে-মিউজিকের নানা প্রসঙ্গে আলোচনা🔯 করেন। তিনি এসবের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের বিভিন্ন দিক নিয়েও নিজের মতামত ব্যক্ত করেন।
কবি, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. রিষিণ পরিমল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন আমাদের জাতীয় চৈতন্যের স্বরূপ, তেমনি বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে মুক্তিলাভের পর, স্বাধীনতা লাভের পর কোরিয়ার মানুষও তাদের মতো করে নিজেদের জাতীয় চৈতন্যকে আবিষ্কার করে♓ছে এবং গর্বের সঙ্গে বলতে শিখেছে, ওরি নারা, বাংলা ভাষায় এর মানে হচ্ছে, আমাদের দেশ। কোরিয়ার সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং বাংলা সাহিত্যের ঐতিত্যের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি। দুই ভাষার সাহিত্যে এই ঐতিহ্যের পরম্পরা কীভাবে বহমান তা ব্যাখ্যা করেন তিনি। আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত তরুণ শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি কোরিয়ার উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাসাহিত্যিকদের একটি তালিকাও উপস্থাপন করেন।
লোকসাহিত্য গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক নূরুননবী শান্ত বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বাঙালির ঐতিহ্যের নানা দিক তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের আহমদ শরীফ ও হুমায়ুন আজাদের মতো লেখকেরাও বলে গেছেন বাঙালি সংস্কৃতি সুনির্দিষ্ট নয়, বরং অনির্দিষ্ট। তিনি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির এখনকার সীমাবদ্ধতা ও মুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেন। শুধু ইউরোপের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নয়, আমাদের মতো সমান্তরাল সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার যারা বহন করছে তাদের দিকে আমাদের আরো মনোযোগী হওয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে উজানের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য রাখেন লেখক ও সাংবাদিক ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ। তিনি বাংলায় অনূদিত ‘কোরিয়ার গল্প’, ‘কোরিয়ার কবিতা’, ‘কো উনের কবিতা’, উত্তর কোরিয়ার অজ্ঞাত লেখক বান্দির গ্রন্থ ‘ফরিয়াদ’, ‘বিটিএস: সিউল টু সোল’সহ উজান প্রকাশনের বিভিন্ন দেশের অনুবাদ সাহিত্য💯ের কথা তুলে ধরেন।
রংপুর শিল্পকলা একাডেমি চার ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা সঞ্চালনা করেন সৈয়দ আরিফুল ইসলাম ও শাহরিয়া সিদ্দিকী সূচনা। সাহিত্য নিয়ে উজানের এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠান এলটিআই কোরিয়ার সহযোগিতায় এই আলোচনার আয়োজন করে প্রকাশনা সংস্থা উজান। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সফল করে তোলার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি কম্পট্রোলার সামসুল হক এবং শিক্ষক সিরাজাম মুনিরাসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। রংপুরে এই আলোচনার আয়োজনে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং বিতর্ক পরিষদ।