• ঢাকা
  • রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


নৌকায় জীবন, নৌকায় মরণ, নৌকা থেকে লাফ দিলেই তালাক!


মো. আবদুল মালেক, লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১, ০৮:৫৭ এএম
নৌকায় জীবন, নৌকায় মরণ, নৌকা থেকে লাফ দিলেই তালাক!

জলেই জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই বসবাস, নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস। ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা বা মৌলিক অধিকার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানি তো নেই, বরং অনিয়ন্ত্রিত জন্মদান, বাল্যবিবাহ আর বহু ব🐠িবাহ এবং কুসংস্কারে ভরপুর আধুনিক যুগে থেকেও লোকচক্ষুর আড়ালে গহিন এক অন্ধকার জীবনে বাস করছে ‘মানতা’ সম্প্রদায়। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র আর ঠিকানাবিহীন বিচ্ছিন্ন এ জনগোষ্ঠী শুধু লক্ষ্মীপুরজুড়ে রয়েছে কমপক্ষে দশ হাজার, আর মেঘনাজুড়ে প্রায় অর্ধলক্ষ। তাদের জীবনাচার দেখে মনে হয় যেন তারা এ যুগের জলচর এক নতুন উপজাতি।

সম্পূর্ণ ভূমিহীন আর জেলে হওয়া সত্ত্বেও এরা পায় না কোনো ভিজিএফ কার্ড, বয়স্ক বা বিধবা ভাতা কিংবা কর্মসৃজনের মতো কোনো কর্মসূচি অথবা ভাগ্যে জোটেনি কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই। উল্টো অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে ভুয়া তালিকা তৈরি করে সুবিধা নিচ্💮ছে মেঘনাপারের জনপ্রতিনিধিরা।

স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এ বিশাল বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারার বাইরে রেখে সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা কিংবা দেশের উন্নয়ন মোটেও সম্ভব নয়। ঠিকানাবিহীন এবং সভ্য সমাজের আলোবিমুখ এ জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের নানা দিক নিয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মেঘনার ভাসমান নৌকায়ই কেটে যায় তাদের ঠিকানাবিহীন জীবন। মৌলিক অধিকার ও সব নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ অন্ধকার জনগোষ্ঠীকে স♎্থানীয়রা বলে ভাসাꦉন জেলে। কিন্তু তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘মানতা’ নামে।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে শুরু করে চর আলেকজান্ডার পর্যন্🔜ত মেঘনার বিস্তৃতি প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। মেঘনার বুকে হাজার হাজার জেলে নৌকার মধ্যে এমন কিছু নৌকা আছে যার চালক স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে বড় এক পরিবার। এদের ঘরবাড়ি আর কর্মস্থল সবই নৌকায়। এরা সব সময়ই থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

অথচ ডাঙাবাসীর প্রতিদিনকার রসনাবিলাসের হাজার রকমের নানা স্বাদের সামুদ্রিক মাছ জোগান দিয়ে আসছে তারা। ডাঙার বিত্তবানদের রসনাবিলাসে প্রতিনিয়ত নিয়োজিত 🍰থাকলেও নিজেদের কোনো রসনা নেই। ইসলাম ধর্ম অনুসারী হলেও জীবিকার প্রয়োজনে তাদের ধর্মও যেন অস্তিত্ব সংকটে।

সরেজমিনে মেঘনাপাড়ের স্থানীয় জেলে, আড়তদার, ঘাটের ব্যবসায়ী আর মানতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লক্ষ্༒মীপুরের রায়পুর থেকে রামগতি পর্যন্ত মেঘনা নদীতে প্রায় আট-নয় শ নৌকায় দশ হাজারের মতো এ মানতা সম্প্রদায় সপরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। যুগ যুগ ধরে বংশপরস্পরায় চলে আসছে তাদের এ পেশা।

সরেজমিন কমলনগর উপজেলার মতিরহাট ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নদীর পাড়ে ভিড়ে রয়েছে শতাধিক মানতা নৌকার বহর। বহরের এক সরদার🧔 লোকমান মানতা জানান, নিজস্ব ঘরবাড়ি বা জমি না থাকায় তারা ডাঙায় বসবাস করেন না। নৌকাই ঘরবাড়ি, এখানেই ৭ স্ত্রী আর ১১ ছেলেমেয়ে নিয়ে ১৯ জনের সংসার। মাছ ধরে, বিক্রি করি আর খান।

তারা কীভাবে এবং কেন মানতা, এমন প্রඣশ্নের উত্🐻তরে সরদার জাফর উল্লা জানান, বেদের মধ্যে রয়েছে অনেক উপসম্প্রদায়। মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার বা মানতা। মানতারা মূলত নদীতে মাছ ধরে।

জাফর মানতার ৩ নম্বর স্ত্রী ফিরোজা বেগম বলেন, “ছোটবেলায় মেঘনা আমাদের ভিটেমাটি নিয়ে যায়। আমি তখন অবিবাহিত। জাফর মানতার সঙ্গে ৩ নম্বর স্ত্রী হিসেবে ঘর বাঁধি। সে নদীতে থাকে, জাতে মানতা, তখন থেকে আমিও তার সাথে হয়ে যাই মানতা।” আবদুল, হাবিব, জব্বার মানতাসহ আরও কয়েকজন জানান, মানতারা জীবনের কোনো না কোনো সময় নদীভাঙনের শিকার। উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষরাই সহায় সম্পদ হারিয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে জীবন বাঁচাতে একসময় মানতা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আর এভাবেই উপকূলী🐼য় এলাকায় প্রতিবছর জীবনসংগ্রামী নতুন মানতাদের সম্প্রসারণ ঘটে। মানতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বহর নিয়ে এরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ান। অনেক সময় জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চলেও এরা ভিড় করেন।

মানতারা নদীতে কী করেন, জানতে চাইলে মধ্য বয়স্ক লুৎফুর রহমান বলেন, “ভাসান বা মানতারা মূলত ছোট বা মইয়া জাল ও বড়শি দিয়ে মাছ ধꩲরে। নদীপাড়ের স্থানীয় বাজারে সে মাছ বিক্রি করে। প্রধানত চিংড়ি, পোয়া, ট্যাংরা, গলসা, পাঙাশ, কাওন মাছ ধরি। খাদ্য কেনার পর যা থাকে, তা দিয়ে জাল আর নৌকা মেরামত করি।&rdq🎃uo;

বৈচিত্র্যময় বিয়ে ও তালাক: প্রতিদিনকার কাজের বাইরেও এদের স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহ আলম মানতা জানান, কর্মজীবন যা-ই হোক, জীবনের নানা ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়েরও রয়েছে বৈচিত্র্যময় কিছু রীতি। তিনি বলেন, “মুসলমান হলেও আমাদের বিয়ের রীতি ডাঙাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর হুজুরের স🧜াহায্যে মাঝে মাঝে কলেমা পড়ানো হয়। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোনো রেজিস্ট্রি হয় না।”

তারা ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে তারা বিয়ের পিঁড়িতে ব🔯সেছেন। মানতাদের বিয়ের সময় গাঙপাড়ের কোনো বাড়ির বাগানে বিয়ের 🐼আসর বসে, তখন তারা গানবাজনা করে, কিন্তু বিয়ের খানাপিনে হয় ওই নৌকাতেই।

জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং সন্তান লালন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুলছুম বলেন♎, তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ করেই না। জন্ম থেকেই নদীর জলে খেলা করতে করতে বড় হওয়া রোকা বেগম জানান, ১৩ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণ-শীর্ণ, রোগাক্রান্ত। রেহাই পাচ্ছে না সংসারযন্ত্রণা থে𝄹কে। ১১ সদস্যের পরিবারে ৯ সন্তানের জননী তিনি। 

মানতারা অভিযোগ করে বলেন, ইতিপূর্বে দেশের কয়েকটি জেলায় বেশ কয়েকজন মানতার নামে আশ্রয়কেন্দ্রের কক্ষ বরাদ্দ নিয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্য💯ক্তিরা। কিন্তু হস্তান্তরের সময় আর তাদের নাম পাওয়া যায়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের নামে বরাদ্দকৃত কক্ষ থেকেও।

সদর উপজেলার চর রমনী মোহন ইউপি চেয়ারম্যান আবু ♏ইউসুফ ছৈয়াল বলেন, “ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মানতাদের মধ্যে যাদের জেলে কার্ড আছে, তাদের ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। আর যাদের নেই, তাদের আমরা ভবিষ্যতে জেলে কার্ডের আওতায় এনে সরকারি সুযোগ-সুবিধা আওতায় আনব।&rdquo🍌;

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম পাট♊ওয়ারী বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় তাদের নিয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে এ সম্প্রদায়ের লোকজনকে হাতে-কলমে ক্ষুদ্র কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের সহায়তা করব।”

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাဣ মোহাম্মদ মাসুম বলেন, “বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মানতাদের স🌳ব সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হবে।”

Link copied!