১৩ নভেম্বর ১৯৩২, শনিবার, দেবকী বসু পরিচালিত 'চণ্ডীদাস' সিনেমা কলকাতার হলে রিলিজ করল। জীবনানন্দ এই সিনেমা দেখবেন ১৮ অগস্ট ১৯৩৩! হলে বসে সিনেমা দেখতে দেখতে তাঁর খুব বেবি বা ওয়াইয়ের কথা মনে পড়তে লাগল। বিশেষত রামিকে দেখে।কী লিখছেন তাঁর ডায়েরিতে জীবনানন্দ:
''চণ্ডীদাস' দেখতে দেখতে প্রতিটি মুহূর্ত আমার ওয়াইয়ের কথা মনে পড়ছিল। ওয়াই তো ইতিমধ্যে সিনেমাটি দেখে ফেলেছে। ওয়াই কি সিনেমাটির প্রতিটি পয়েন্টস্ যথাযথ বুঝেছে? সিনেমাটি দেখতে দেখতে তার কি আমার কথা মনে পড়েছে? অথবা কবি ও কবিতা নিয়ে কোনও ভাবনা মনে জেগেছে?... আমার মনে এই প্যাশন নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই, একদম পরিষ্কার... এই আবেশ বা ঘোর আমাকে ঘিরে থাকে যে ওয়াই হল একমাত্র মহিলা আমার জীবনে আর তার প্রেম একমাত্র প্রেম আমার আত্মার।'
কে অভিনয় করেছিলেন এই রামির চরিত্রে? দেবকী বসু যখন এই ছবির কাস্টিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন কিছুতেই নায়িকা পছন্দ হচ্ছিল না ওঁর। উমা নামের একজন মঞ্চ অভিনেত্রী জানতে 🍸পারলেন সিনেমার জন্য দেবকী বাবুর এই সুগায়িকা ও নায়িকার সন্ধানের কথা। খানিক খানিক ভয়ে ভয়েই উমা গেলেন দেবকী বাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তারপর তো দেবকী বাবু যে গানই গাইতে বলেন সেটাই চমৎকার গেয়ে শোনান। এভাবেই গানের পর গান চলতে থাকে। ওঁর গায়কীতে মুগ্ধ দেবকী বাবু নায়িকা নির্বাচনে বেশি সময় নেননি আর। ‘চণ্ডীদাস’এর হাত ধরে নতুন অধ্যায় শুরু হয় উমার জীবনে। মঞ্চের উমা হয়ে উঠলেন সিনেমার উমাশশী।
মিনার্ভা থিয়েটার তখন জমজমাট মঞ্চতারকা মিস🐎 লাইট, চারুশীলা, রেণুবালাদের নাচ গান অভিনয়ে। তারই মধ্যে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে দাপটের সঙ্গে নিজ গুণে জায়গা করেꦇ নিয়েছিল মিনার্ভায়,নাম তার উমা। মিনার্ভায় আত্মপ্রকাশ করে কেরিয়ারের পরের পর্যায়ে পূর্ণ থিয়েটারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন উমা।
কী এমন ছিল 'চণ্ডীদাস' সিনেমায় যে জীবনানন্দ নিজেকে চণ্ডীদাস ও ওয়াই-কে রামির ভূমিকায় ভাবতে শুরু করলেন! কী লেখা ছিল 'চণ্ডীদাস' সিনেমার প্রচার পুস্তিকায়:
'পুকুরের এপার থেকে রামীর চোখ হ’তে যে-শর নিক্ষিপ্ত হ’তো তাতে চণ্ডীদাসের মাছধরার চার রোজই ঘুলিয়ে যেত; কিন্তু তাতে কি-ই বা এসে যায়। রামী চণ্ডীদাসকে ভালবাসতো। মনে মনে সে চণ্ডীঠাকুরকে পূজা করতো। বাইরে কিন্তু রামী ছিল চণ্ডীদাসের কাছে কখনও একটি প্রহেলিকা, কখনও বা একেবারে নির্ভরা।
এমনি একদিন এক সকালে, পুকুর ঘাটে কাপড় কাচতে-কাচতে রামী আপন মনে গান গাচ্ছিল, “বঁধু কি আর বলিব তোরে, অলপ বয়সে পিরীতি করিয়া রহিতে না দিলি ঘরে"। সে গান গাচ্ছিল চণ্ডীদাসেরই রচিত গীতি, আর ভাবছিল তাকেই। হঠাৎ দৃষ্টি পড়লো ওপারে। হায়, ঠাকুরটা ঠিক এসে দাঁড়িয়েছেন ছিপ হাতে ওপারে, এক কাঠ-করবীর ঝোপের পাশে। আজি হঠাৎ রামীর চিত্তে শাশ্বত তরুণ, মনের চাঞ্চল্য জেগে উঠলো তার। সঙ্গীতে, তার ভঙ্গীতে, তার চক্ষের চাহনীতে! চণ্ডীদাসকে লক্ষ্য করে রামী চণ্ডীদাসেরই রচিত গানের একটী চরণ বারবার বিচিত্র ভঙ্গীতে গাইলো। সে যেন চণ্ডীদাসেরই কাছে জানতে চায় যে, এই যে এমন করে রামী তাকে ভালবাসলো এখন উপায় কি হবে গো? চণ্ডীদাস উত্তর খুঁজে পান না, উত্তর যদি বা মনে আসে কিম্ব মুখে আসে না। শেষে রামী যখন গান ছেড়ে দিয়ে রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিল তখন চণ্ডীদাস তার উত্তর খুজে পেলেন।'
আমরাꦺ জানি রামি ও চণ্ডীদাসের প্রেমের পথে হাজার বাধার কথা। সুগম নয় কণ্টকিত ছিল সেই পথ। চণ্ডীদাসের স্ত্রী ছিল। রামি রজকিনী আর চণ্ডীদাস পূজারি। জীবনানন্দ দাশ ও ওয়াইয়ের প্রেমের পথও সুগম ছিল না। জীবনানন্দ দাশও বিবাহিত। অথচ ওয়াইয়ের প্রতি তীব্র প্যাশন ও প্রেম।
আমরা বুঝতে পারি কোথায় 'চণ্ডীদাস' সিনেমাটি জীবনানন্দ দাশকে তোলপাড় ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছে। সবথেকে বড়ো কথা জীবনানন্দ দাশও চণ্ডীদাসের মতো একজন কবি আর ওয়াই রামির মতো তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ। চণ্ডীদাসে কবিতা যেন জীবনানন্দের কবিতা হয়ে উঠছে:
এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি |
পরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি ||
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া |
আধ তিন না দেখিলে যায় যে মরিয়া ||
জল বিনু মীন জনু কবহুঁ না জীয়ে |
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে ||
দুগ্ধে আর জলে প্রেম কিছু নাহি স্থির |
উথলি উঠিলে দুগ্ধ জল পাইলে ধীর ||
ভানু কমল বলি সেহ হেন নহে |
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রহে ||
চাতক জলদ কহি সে নহে তুলনা |
সময় নহিলে সে না দেয় এক কণা ||
কুসুমে মধুপে কহি সেহ নহি তুল |
না আইলে ভ্রমর আপনি না যায় ফুল ||
কি ছার চকোর চাঁদ দুহুঁ সম নহে |
ত্রিভূবনে হেন নাহি চণ্ডীদাস কহে ||
কালক্রমে 'বনলতা সেন' হয়ে উঠবে যে রমণী তাকে আমরা এমন নানান আভায় আলোকিত হয়ে পথ চলতে দেখি।