টরন্টো বর্ণিল। জাতি ও রাষ্ট্রের বিচারে। এবং আদিবাসীদের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল। উৎসবে প্রতিটি স্ক্রিনিংয়ের আগে কানাডা নামক ভূখণ্ডে যারা আদিবাসী, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়—অন্য সব জাতির লোকজনের সঙ্গে যে তারা তাদের ভূমি ভাগাভাগি করে নিয়েছে—সে জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এখানে বোর্ডিং স্কুল প্রথা চালু ছিল, সেখানে জোরপূর্বক আদিবাসী ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানো হতো। তখন থেকে অনেক বাচ্চারই আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ বানোয়াট গল্প বলে পরিবারকে সান্ত্বনা দিত। কিন্তু বছর কয়েক আগে কানাডার ব্রি🅠টিশ কলাম্বিয়াতে দুই শ পনেরোটি আদিবাসী শিশুর গণকবর আবিষ্কারের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। এরপর থেকে আদিবাসীদের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখানে।
আদিবাসী সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ব্যাপারে অন্য রকম যত্ন লক্ষ করার মতো। আদিবাসী নারী, আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা, আদিবাসী লেখক, চলচ্চিত্রে আদিবাসী চরিত্র এ রকম নানা বিষয় নিয়ে এখানে বিস্তর বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপারটি ভালো। কিন্তু ইতিহাস তো কেউ ভুলে যায়নি। ফরাসি ও ব্রিটিশ উপনিবেশ দুজনের হাতই কানাডার আদিবাসীদের রক্তে রঞ্জিত। সেটার জন্য তারা এখন দুঃখ প্রকাশ করছে। তা-ও ভালো। পাকিস্তান যা করেছিল বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে, সেটার জন্য দুঃখ প্রকাশ তো দূরে থাক, লজ্জাও পায় না তারা। এমনকি পারলে ইতিহাস থেকে ১৯৭১ সালটাকেই মুছে ফেলতে চায়। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে চায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ও এর সার্বিক দিক নিয়ে এখনো আমরা কোনো আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র তৈরি করে উঠতে পারিনি। করে উঠতে পারলে এই বিস্মৃতির খেলা ভুলিয়ে দেওয়া যেত।
উৎসবের দশম দিন আজ। শনিবার। স্কশিয়াব্যাংকে ঢুকলাম ঠিক পাঁচ মিনিট আগে। সময়মতো নিং হাও পরিচালিত ছবি ‘দ্য মুভি এম্পেরর’ শুরু হলো। চীনা চলচ্চিত্র। টিফেই ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে। চলচ্চিত্র কারখানা ও চিত্রতারকাদের নিয়ে এক ব্যঙ্গধর্মী চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র উৎসবকে মাথায় রেখে, পুরস্কার পাওয়ার বাসনা কীভাবে একটি ছবির নির্মাণ প্রক্রিয়ায় চেপে বসে, তার কৌতুকপূর্ণ বয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে বসে দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে হংকং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকা লাও ওয়াই-চাইকে ঘিরে। বেচারা পুরস্কারপ্রত্যাশী। কিন্তু পাচ্ছে না। তাই কঠোর পরিশ্রম করতেও তৈরি। কিন্তু ওদিকে ঘর টিকছে না। ডিভোর্স হয়ে গেছে, স্ত্রী যেকোনো মুহূর্তে আলাদা থাকা শুরু করবে। ঘর ও কাজের জায়গায় হতাশা জমতে জমতে দিশাহারা হয়ে ওঠে লাও। এরই মধ্যে ছবিতে ঘোড়া নিয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য নিয়ে নেটিজেনরা ঝড় তোলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। পশুপ্রেমী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে আরও ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে লাও। এসব ডামাডোলে নতুন ছবির শুটিং লাটে ওঠে। পরিশেষে পরিচালক আমাদের দেখান ইলেকট্রনিক স্কুটার বা হোভার চালাতে শিখছেন লাও। পাশাপাশি দুই চাকা থাকা যন্ত্রটি চালাতে ব্যালান্স রাখা শিখতে হয়। ছবিটি শেষ করার জন্য এর চেয়ে চমৎকার দৃশ্য আর কী হতে পারে? একজন বিধ্বস্ত সুপারস্টার, চলচ্চিত্রের পরাজিত সম্রাট শিখে নিচ্ছেন কী করে ভারসাম্য রাখতে হয়: আম ও ব্যক্তিজীবনে।
ছবি দেখে হালকা উষ্ণ রোদ মাখতে মাখতে প্রেস লাউঞ্জে ঢুকি। ‘ফ্রিডম জার্সে’র ক্যালি বেরি বয়াম একটা নিয়ে লিখতে বসেছি। ‘ক্যালি বেরি’ হলো ভেগান কোকোনাট ইয়োগার্ট, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি, খেজুর ও নারিকেল মেশানো একটি স্ন্যাকস। বয়ামের ভেতর রাখা থাকে। বেশ আয়েশ করে খেতে খেতে লিখছি। এমন সময় লাউঞ্জে ঢুকলেন ইন্দিরা। তিনি ভারতীয়, তবে কানাডাপ্রবাসী, সাংবাদিকতা করেন টরন্টোর এক টিভি চ্যানেলে। উৎসবে এসে দ্বিতীয় দিনই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আজ বললেন, তিনি বাংলাদেশের ‘রেইনকোট’ টিফে দেখেছেন। তার মনে থাকার কারণ ওই বছরই তিনি প্রথম কানাডা এসেছিলেন। আমি বললাম, ছবিটির বাংলা নাম ‘মেঘমল্লার’, টিফে দেখানো হয় ২০১৫ সালে। ইন্দিরা আরও একটি বাংলাদেশি ছবির নাম বললেন, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। যেহেতু ভারতীয় এবং তার স্বামী সম্ভবত কিছুদিন বাংলাদেশে ছিলেন, তাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তার আগ্রহ রয়েছে। কথায় কথায় বাংলাদেশের জন্য রিপোর্ট বা স্টোরি পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি আমার ভিজিটিং কার্ড দিলাম। ইন্দিরা চলে গেলে মনোযোগ দিলাম লেখায়। যদিও এর ফাঁকে অফিসেও কিছু নির্দেশনা দিতে হচ্ছিল।
দুপুরের খাবার খেয়ে আবার থিয়েটারে। এবারেও চীনা ছবি। তবে পুরোপুরি চীনা বলা যাবে না। বলতে হবে তিব্বতি-চীনা। নাম ‘স্নো লেপার্ড’। দুঃখের বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তিব্বতি পরিচালক পেমা সেডেনের এটিই সর্বশেষ ছবি। তিনি এ বছরেরই ৮ মে মারা গেছেন। ছবির কাজ তিনি শেষ করে যেতে পেরেছিলেন। তিব্বতের সত্য কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি আবর্তিত হয়েছে একটি স্নো লেপার্ড বা তুষার চিতাকে কেন্দ্র করে। একবার এক খামারির ভেড়ার পালে হামলা চালায় তুষার চিতা। তিনটি ভেড়াকে সে মেরে ফেলে। গ্রামবাসী আটকে ফেলে চিতাটিকে। চীনে এই প্রাণীকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়, যেহেতু এরা বিরল প্রজাতির। সরকারি লোক ও পুলিশ এসে গ্রামবাসী, বিশেষ করে খামারিকে বলে চিতাকে ছেড়ে দিতে, কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তিনটি ভেড়ার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? সরকারি পক্ষ থেকে কেউ দিতে রাজি নয়। এ নিয়ে শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা।
পরিচালক গ্রামবাসীদের দয়ালু মনটাও দেখিয়েছেন। খামারির নাম জিনপা, সে ও তার সঙ্গীরা যখন দেখে চিতাটির একটি বাচ্চা রয়েছে, সে তার জন্যই শিকার ধরতে এসেছে, তখন একটি মরা ভেড়া বাচ্চাটির জন্য রেখে আসে। পরে অনেক নাটকীয়তা শেষে চিতাটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সে জন্য চিতাটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই গল্পের ভেতর দেখা যায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে। তাকে সবাই স্নো লেপার্ড মঙ্ক বলে চেনে। এর কারণ তুষার চিতার প্রতি তার ভালোবাসা ও গবেষণা। আগে একবার গ্রামে এই চিতাটিই ধরা পড়েছিল, তখন ভিক্ষুটি তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এক বছর পর তপস্যা শেষে ভিক্ষু যখন পাহাড়ি পথ ভুলে এক বরফাচ্ছাদিত চূড়ায় বসেছিল, তখন ওই চিতাটিই তাকে পিঠে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। চিতাটি মা হওয়ার পর আবার এই ভিক্ষুর সঙ্গে দেখা হলো গ্রামে। চিতা তাকে চিনতে পারে। তাই কোনোরকম হিংস্রতা ছাড়াই সে চলে যায়।
একটি হিংস্র জানোয়ারের ভেতর ভালোবাসার বীজ বুনে দিতে পারে মানুষ। যে মানুষ সর্বক্ষণই যুদ্ধ ও মারামারি করছে, সেই মানুষই হতে পারে প্রেমের আধার। পরিচালক পেমা ছবিটি করার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছেন। ছবির প্রদর্শনী শেষে মঞ্চে আসেন পরিচালক পেমার ছেলে, তিনি বাবার কাজে সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন, এ ছাড়া যোগ দেন সিনেমাটোগ্রাফার ম্যাথিয়াস দলভ্যু ও অভিনেতা জিওং জিকি। তারা জানান, চলচ্চিত্রে খামারির চরিত্রের নাম ছিল জিনপা, যার অর্থ দিয়ে ‘দেওয়া বা ছেড়ে দেওয়া’। নামের সার্থকতা আমরা ছবিতে দেখেছি। তিব্বতি ভাষা নিয়ে যথেষ্ট বাড়ির কাজ করেছিলেন পরিচালক পেমা। ছবির ভেতর তিব্বতি বর্ণমালা নিয়ে কথা বলার সময় আমি লক্ষ করলাম বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে অনেক মিল উচ্চারণের দিকে থেকে: ক, খ, চ, ছ ইত্যাদি।
ছবিটির দৃশ্যায়ন চোখে প্রশান্তি দেয়। আর গল্পটার ভেতর একধরনের আধ্যাত্মিকতা আছে। পাশাপাশি রয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনের দ্বন্দ্ব ও দূরত্বের বয়ান। কানায় কানায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ হাততালি দিয়ে ছবিটিকে অভিনন্দন জানায়। দর্শকদের উচ্ছ্বাস দেখে টিফের ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামার জানালেন তারা ভবিষ্যতে পরিচালক পেমা সেডেনের রেট্রোস্পেকটিভের আয়োজন করবে। আমারও ভালো লেগেছে পেমা সেডেনের কাজ। যদিও এই ছবিতে কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহারে আরেকটু যত্নবান হওয়ার সুযোগ ছিল। তারপরও বলব, তুষার চিতার মতো একটি হিংস্র প্রাণী নিয়ে এমন চলচ্চিত্র, তুষার চিতার মতোই বিরল।
আজকের দিনের মতো ছবি দেখার ইতি টানলাম। থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এবার গন্তব্য কানাডিয়ান ন্যাশনাল টাওয়ার ভ্রমণ। পুত্র মনে খুব চাইছে ওপরে উঠতে। তার মা তাই নিয়ে এসেছে। আঠারো শ ফুট উঁচু টাওয়ারে লিফট দিয়ে উঠতে উঠতে মনে আমাদের জিজ্ঞেস করছিল তোমাদের কি ভয় লাগছে? ভয় পেয়ো না, কিচ্ছু হবে না। বললাম, বাবা তুমি আছো আমাদের সঙ্গে, আর কিসের ভয়? আমরা প্রায় এক হাজার ফুট ওপরে উঠে গোধূলিবেলার টরন্টো দেখলাম। অন্টারিও লেকের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটি ধীরে ধীরে আলোতে সজ্জিত হচ্ছিল সন্ধ্যা নামার মুখে। ওপর থেকে কাচের মেঝে দিয়ে নিচে থাকা বেসবল মাঠ, অ্যাকুরিয়াম ও পিঁপড়ার মতো গাড়িদের চলাচল দেখলাম। অনেকেই স্বচ্ছ মেঝেতে শুয়ে-বসে ছবি তুলছে। অনেকে আবার উচ্চতাভীতির কারণে পা রাখছে না ওখানে। শুধু উঁকি মেরে দেখছে। মনে দেখলাম সাবলীলভাবে কাচের মেঝেতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে তাকিয়ে সবকিছু দেখছে। ভয়ডর নেই!
১৯৭৬ সালে বানানো মিনারটির মাথায় নাকি বছরে গড়ে পঁচাত্তরবার বজ্রপাত হয়। মনে এটা জেনে বেশ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা এখন বজ্๊রপাত হলে কি আমরা মরে যাব? তাকে আশ্বস্🍬ত করা হলো মেঘের বিদ্যুৎকে হজম করে ফেলার প্রযুক্তি এই মিনারের আছে। আমরা প্রায় রাত নয়টা পর্যন্ত পাখির চোখে টরন্টোর নাগরিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। তারপর ডানায় স্মৃতি মেখে নীড়ে ফিরলাম।