দুনিয়া বেরহম। আর সেই দুনিয়া যদি হয় বাংলাদেশ, তবে সেই নির্মমতা সকল সংজ্ঞাকে ছাড়িয়ে চলে যায় তুরীয় কোনো এক জগতে। মনে হয় আমরা এক ডিসটোপিয় নগরের বাসিন্দা। যেখানে প্রাণের মূল্য নেই, প্রেমের মূল্য নেই। এক স্থবির, নিষ্ঠুর ও লোভী সমাজে মা🐻নুষ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই বোধহয় প্রকৃত মুক্তি। সেই মুক্তিই কি চেয়েছিল মালতী?
পরিচালক শঙ্খ দাশগুপ্ত ‘প্রিয় মালতী’ চলচ্চিত্রে এমন বয়ান রচনার চেষ্টা করেছেন, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান আছে, তার ভেতরে স্তরে স্তরে আছে প্রাণের প্রতি আমাদের অবহেলা, অমূল্য জীবনের মূল্যহীনতার কথা। এই নগরে কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি, একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটেছে। পুড়ে গেছে কলকারখানা, ঘরবাড়ি। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মানুষ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ। পুরান ঢাকা সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চয় আমরা ভুলে যাইনি। আর আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত নগরীর যানজটে আটকে থাকা পরিগ্লানযানে ছটফট করতে থাকা মুমূর্ষু মানুষের আহাজারি যখন গগনবিদারী সাইরেন হয়ে আমাদের সন্ত্রস্ত করতে চায়, তখন আমাদের নির্বিকার থাকাটাও খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নির্মাতা শঙ্খ সেই কঠিন বাস্তবতার শঙ্খধ্বনিই শোনাতে চাইলেন ‘প্রিয় মালতী’তে।
সমাজে যখন কোনো কিছুর প্রস্থান ঘটে, তখন শিল্পে তাকে আহ্বান জানানো হয়। ‘প্রিয় মালতী’তে যখন সনাতন ধর্মের মানুষ পলাশ-মালতীর পাশে স্বার্থত্যাগ করে মুসলমান পরিবারের সদস্য রাজ্জাক সকল বিপত্তিকে উপেক্ষা করে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, তার অর্থ হয়—সবার উপর মানুষ সত্য, কিন্তু পরিতাপের বিষয় সমাজে এই বোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব রয়েছে। এখন তো নিজেদের সম্প্রদায়ের ভেতরেই রক্তারক্তির ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানুষের তৈরি এই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ফুটিয়ে তোলা ছাড়াও নির্মাতা কয়েকটি প্রশ্ন ও বিস্ময়সূচক চিহ্ন ছুড়ে দিয়েছেন🍸 দর্শকের দিকে।
যেমন এই সমাজে সত্যের মূল্য নেই, তারা মিথ্যা কাগজ খোঁজে। ওটার দাম আছে। মিথ্যা কাগজ দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করায় সমাজ যতটা আগ্রহী, ঠিক ততোটাই নির্জলা সত্যকে দেখতে অনাগ্রহী। এই সমাজে মৃত সন্তানের চেয়ে অর্থের মূল্য বেশি। পেরুতে যেমন সোনারখন♏িতে সোনালোভীদের জানবাজি রাখা অভিযান শুরু হয়েছিল, এই সমাজেও সকল শোককে ভাসিয়ে দিয়ে, পুত্রের শবদেহের বিনিময়ে অর্থপ্রাপ্তিটাই আসল। পলাশের পিতা যেন স𝓡েই পেরুতে ছুটে যাওয়া সোনালোভীদেরই একজন। শঙ্খ খুব চমৎকার করে এই দৃশ্যটি বুনেছেন। বিস্ময়চিহ্ন রেখে গেছেন।
প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়েছেন আরেক দৃশ্যে, মালতী যখন আইনি সহায়তার জন্য একজন আ𝓡ইনজীবীর কাছে যায়। অসহায় জানার পরও মক্কেলকে রেয়াদ দিতে রাজি নয় এই ভদ্রলোক। ঠিক এরই মতো মালতীর বাড়িওলা। এই লোকও মালতী বাঁচল, কি মরলো তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। পূজার ঘন্ট෴া তার কাছে মনে হয় বিরক্তিকর, কারণ তার নাতি নাকি সেই ঘন্টা শুনে আইসক্রিমের ফেরিওলা এসেছে ভাবে, আর বায়না জুড়ে দেয়।
তবে এই গোটা ছবিতে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন ঝুলিয়ে রেখেছেন শঙ্খ, তা হলো, মানুষ কি তার স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার বা সুযোগটুকুও পাবে না? চিকিৎসা পাবে না? এই 🌠নির্জীব, নির্বিকার ও নিষ্ঠুর শহরে অসহায় মৃত্যুর কাফেলা দেখে যাওয়াই কি আমাদের ভবিতব্য? কারো মৃত্যুতে কি কারো কিছুই যায় আসে না🍬? মানুষের জীবনের মূল্য কি অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায়? তার কি স্বপ্ন, বাসনা বলে কিছু থাকতে নেই? মানুষ কি তবে এই অসভ্য নগরে কীটপতঙ্গ মাত্র?
একই কথা কি আমরা প্রতিদিন শুনি না? পড়ি না? গণমাধ্যমে কি এসব নাগরিক সঙ্কট, সামাজিক অসহিষ্ণুতার খবর ও ঘটনা প্রচার করে না? করে তো। আমরা তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসব ঘটনা নিত্যদিন দেখি, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ক্রল করে সামনে এগিয়ে যাই। এই একবিংশ শতকে আমাদের দুঃখ প্রকাশের সময় যেন একুশ সেকেন্ড! ‘আহা’ উচ্চারণ করে আমরা পুনরায় অন্ধ ও বধিরে পরিণত হই। আমাদের চারপাশের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প আমাদের সচেতন ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করে না। আꦿমাদের চারপাশে নানাবিধ অবহেলা ও অব্যবস🍎্থাপনার দরুণ মৃত্যুর ঘটনা আমাদের আন্দোলিত করে না। আমরা যেন জম্বিতে পরিণত হয়েছি। কিছুতেই আর কিছু হচ্ছে না আমাদের। কোনো হেলদোল নেই। মানুষ চরম ভোগান্তিতে আছে, তাতে আমার কি! মানুষ পোকামাকড়ের মতো মরছে, তাতে আমার কি! মানুষ চরম লোভ ও নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছে, তাতে আমার কি! আমরা যেন সব দেখেশুনেও কিছু দেখছি না, শুনছি না। এমন এক পরাবাস্তব, অবিশ্বাস্য সময়ে শঙ্খ যে ধ্বনিচিত্র রচনা করলেন, সেই শঙ্খধ্বনি কি আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণে প্রবেশ করবে? করুক আর না করুক, কাউকে না কাউকে তো চিৎকার করে যেতে হয়। নির্মাতা সেই কাজটিই করেছেন।
মালতীর চরিত্রে মেহজাবীন চৌধুরী যে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন, পাশাপাশি শাহজাহান সম্রাট, রিজভি রিজু চৌধুরী, আজাদ আবুল কালাম প্রমুখরা যে পারদর্শী চরিত্রায়ণ করেছেন, তাতে আমার মনে হয়েছে নির্মাতার গল্পটি বলতে অনেক সুবিধা হয়েছে। শেষ করবো এটা বলেই যে, ‘প্রিয় মালতী’ প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের সমাজের এক দীর্ঘশ্বাস। যা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডে। পরমুহুর্তের নিঃশ্বাসেই আমরা আবার অনুভূতিহীন জড় পদার্থে পরিণত হই। তারপরও শঙ্খ বাজুক।