কাঠবিড়ালির রাস্তা পেরুবার দৃশ্যগুলো অসাধারণ লাগে এখানে, বিশেষ করে গাছগাছালি ঘেরা হেলসিতে। চঞ্চল কৃষ্ণ কাঠবিড়ালি অবলীলায় তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে বৃক্ষপল্লবের আড়ালে হারিয়ে যায়। গাছের সাথে চলচ্চিত্র উৎসবের একটা মিল আছে। গাছের যেমন নানা শাখাপ্রশাখা থাকে, চলচ্চিত্র উৎসবেও তেমনি থ🅺াকে নানা জঁরা। আমরা যারা সিনেফিল তারা কাঠবিড়ালির মতো বিচিত্র চলচ্চিত্রের অরণ্যে হারিয়ে যাই। আজ সপ্তম দিন। না, তাই বলে বিশ্রামবার নয়। উৎসব চলছে, যদিও অনেক আয়োজন এরই মধ্যে গুটিয়ে গেছে। যেমন স্ট্রিট ফেস্টিভাল। ওটা উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রথম চারদিন বসেছিল। খাবারদাবার নানাবিধ আয়োজন ছিলো তাতে। কনসার্টও চলেছে টানা চারদিন। মাঝখানে পাঁচদিনব্যাপী চলেছে ইন্ডাস্ট্রি কনফারেন্স। তারও সমাপ্তি ঘটেছে। এখন ভাটার টান পড়ছে উৎসবে। তবে আমি এখনো ঢেউয়ে ভাসছি।
ভাসতে ভাসতে টিফের ভবন বেল লাইটবক্সে এসেছি ফ্রান্স-লুক্সেমবার্গ-নেদারল্যান্ডস প্রযোজিত চীনা প্রামাণ্যচিত্র ‘ইয়ুথ (স্প্রিং)’ দেখার জন্য। পরিচালকের নাম ওয়াং বিং। ছবিটি রাখা হয়েছে ‘ওয়েবলেংথস’ বিভাগে। এই বিভাগে উদীয়মান মেধাবী পরিচালকদের ছবি রাখা হয়। গতানুগতিক নিয়ম ভাঙা ছবি, বিশ্বকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করা ছবি। বিংয়ের ছবিটি দেখতে বসে অনুধাবন করা গেলো এই ছবি এই বিভাগের জন্যই উপযুক্ত। চীনের পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে করা ছবি, দৈর্ঘ্য প্রায় চার ঘন্টা। পোশাক শ্রমিকদের জোটবদ্ধ হয়ে থাকা, তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে আক্ষেপ, তাদের ছোটখাটো আনন্দ-বেদনা, তাদের সংকট ও কর্মপরিবেশ নিয়ে এক মোজাইক ছবি। এখানে কোনো একরৈখিক গল্প নেই। শ্রমিকদের একেকটি দলে থাকা একেকজন শ্রমিকের মিথষ্ক্রিয়াই এই ছবির জ্বালানি। ছবির ফোকাস তরুণ শ্রমিকদের উপর। ক্যামেরা স্থির হয়ে বসেনি কোথাও, চরিত্রদের অনুসরণ করেছে ছায়ার মতো।
ছবিটি পরিচালকের ‘ইয়ুথ’ ত্রয়ীর প্রথম পর্ব। পয়লা পর্বের নাম ‘স্প্রিং’। এই ছবিতে চীনের বর্তমান তরুণদের অবস্থা কেমন সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন ওয়াং বিং। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, চীনে যখন বিপ্লবের বাতাবরণ সর্বত্র, তখন বিপ্লবী চেতনাকে জাগ্রত রাখতে তারুণ্য শব্দটি প্রচুর ব্যবহার করা হতো। সেই তারুণ্য শব্দটি পুনঃউদ্ধারের চেষ্টা করেছেন বিং। তিনি চেয়েছেন ‘তারুণ্যে’র ধারণাকে এই শতাব্দীতে তার মতো করে তর্জমা করতে। ছবিটি ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবেও অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিলো।
প্রামাণ্যচিত্র থেকে এবার কাহিনিচিত্রে, তাও আবার হলিউড স্পোর্টস মুভি, সত্যি কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত। বহুদিন পর জুডি ফস্টারকে দেখলাম। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্ব’, ‘কনট্যাক্ট’ ছবিতে তার দুর্দান্ত অভিনয় ভোলার নয়। নতুন ছবিতেও তিনি অনবদ্য, যদিও পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। মূল চরিত্র সাঁতারু ডায়না নাইয়াডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অ্যানেট বেনিং। ডায়ানা যুক্তরাষ্ট্রের কাল্ট সুইমার। এই ভদ্রমহিলা নিজের তারুণ্যের অধরা স্বপ্নকে পূরণ করতে পুনরায় নিজেকে তৈরি করেন ষাট বছর বয়সে। পাঁচবারের চেষ্টায় নাইয়াড কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা সাঁতার কেটে যেতে সক্ষম হন, তাও শার্ক থেকে বাঁচতে কোনো রকম খাঁচা ছাড়া। আর এই দুঃসাহসিক অভিযানে তার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন বন্ধু ও কোচ বনি স্টল। বনির চরিত্রেই অভিনয় করেছেন জুডি।
এলিজাবেথ চাই ভাশারেলি ও জিমি চিন পরিচালিত ছবি ‘নাইয়াড’ যখন চলছে তখন হলভর্তি মানুষ। কিছুক্ষণ পরপর চোখের পানি মুছছে। ছবিটি প্রকৃত অর্থেই খুবই প্রেরণাদায়ী ও উৎসাহব্যঞ্জক। যে কোনো মানুষকে ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে পারে ছবিটি। ভাবা যায়! ষাট বছর থেকে পাঁচবার চেষ্টা করে চোষট্টি বছর বয়সে এসে কিউবার হাভানা থেকে ফ্রোরিডার কি-ওয়েস্ট পর্যন্ত ১১০ মাইল পারি দিয়েছেন নাইয়াড, টানা প্রায় ৫৩ ঘন্টা সাঁতার কেটে। সকলেই যখন বারবার বলছিলেন, হবে না, নারী, তাও ষাটোর্ধ্ব, তখন ডায়না নাইয়াড সেটা করে দেখিয়েছেন। ছবির শেষে নাইয়াড যখন কি-ওয়েস্টের মাটিতে পা রেখেছেন, তখন সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তিনটি জিনিস মনে রাখবেন: এক, কখনো নিজের স্বপ্নকে ধাওয়া করা ছাড়বেন না। দুই, বয়স কখনো কোন কিছু শুরুর বাধা হতে পারে না। আর তিন, মনে হতে পারে একা একা কেউ কোনো কাজ করছে, কিন্তু টিম ছাড়া কেউই একা একা কিছু করতে পারে না।
কবিতা ও গানের ব্যবহার ছবিটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। ছবিতে মার্কিন কবি মেরি অলিভারের কবিতার কিছু লাইন বারবার এসেছে, মোটিফের মতো:
Tell me, what else should I have done?
Doesn`t everything die at last, and too soon?
Tell me, what is it you plan to do
with your one wild and precious life?
ছবিটি আমার ভালো লেগেছে। ভালো লাগার আরো একটি কারণ এখানে আমার প্রিয় একটি গান ব্যবহার হয়েছে। সাইমন ও গারফাংকেলের গাওয়া ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’। এই গানটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়: স্তব্ধতার গান শোনো। দুটি গানই আপন জগতের অন্ধকার ও স্তব্ধতার মুখোমুখি বসে বোঝাপড়ার কথা বলে। এই বোঝাপড়া ছাড়া জীবন অচল।
খাবার ছাড়াও জীবন চলবে না। আজ স্ট্রিটফুড খাব বলে ঠিক করেছি। লাইটবক্সের উল্টো দিকের পার্কে একটি ভ্যানে শুধু হটডগই বিক্রি করেন এক নারী। পাঁচ কানাডিয়ান ডলার দিয়ে হটডগ কিনে খেতে খেতে পা বাড়াই প্রেস লাইঞ্জের দিকে। লাউঞ্জে ঢুকে আপেলের জুস নিয়ে জার্নাল লিখতে বসি। কানে বাজছে: Hello darkness, my old friend / I`ve come to talk with you again... এমন সময় উল্টো দিকে এক সাংবাদিক এসে বসলেন। তিনি ল্যাপটপে প্লাগ লাগাতে লাগাতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার টি-শার্টটি আমার পছন্দ হয়েছে। আমি জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ লেখা টি-শার্টটি পরেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে এই উপন্যাসটিও এক অন্ধকার সময়ের কথা বলে।
বাইরে মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বৃষ্টি না নামলেই হলো। একটু পর দেখতে যাব তুরস্কের বিখ্যাত পরিচালক নুরি বিলগে জেলানের নতুন ছবি ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাস’। জেইলানকে বলা হয় বর্তমান বিশ্বের আর্ট-হাউজ ফিল্মের অন্যতম প্রভাবশালী নির্মাতা। তার নতুন ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে তুরস্ক, ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইডেন।
মন মতো আসন পাওয়ার জন্য বেলবক্সে আধঘন্টা আগেই চলে গেলাম। আশা ছিল ছবি শুরুর আগে ও পরে মাস্টার ফিল্মমেকার জেলানের কথা শুনতে পারবো। কিন্তু জানা গেল তিনি আসতে পারেননি। যাক, ছবি তো এসেছে। ঘর অন্ধকার করে শুরু হলো জেলানের নতুন জাদু। চোখ ছানাবড়া করা সিনেমাটোগ্রাফি! তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে এক প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আর্ট শেখায় মধ্যবয়সী সামেট। অবিবাহিত, দ্বিধাগ্রস্ত এবং দিনযাপনে কিছুটা নিহিলিস্ট। স্কুলেরই এক ছাত্রী সেভিমের সঙ্গে তার ‘প্রেমে’র সম্পর্ক। সেভিম তাকে পছন্দ করে, কিন্তু এক প্রেমপত্রকে ঘিরে সেভিম শিক্ষকের শত্রু হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে শুরু করে সেভিম। সামেটও প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। স্কুলেরই আরেক আকর্ষণীয় পুরুষ শিক্ষক কেনানের সঙ্গে একই বাসায় থাকে সামেট। প্রতিশোধ নিতে অভিযোগ করা হয়েছে এই দুই শিক্ষকের নামেই। এটা করেছে সাভেম ও তার এক বান্ধবী। এরই মধ্যে সামেট ও কেনান, এই দুই অবিবাহিত পুরুষের জীবনে আসে আরেক স্কুলের নারী অঙ্কন মাস্টার নুরে। নুরে বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল, একটি পা নেই তার। নুরের সাথে পূর্বপরিচয় ছিল সামেটের। সামেটই নুরেকে পরিচয় করিয়ে দেয় কেনানের সাথে। এই ছবির সবচেয়ে চিন্তাঘন জায়গাটি হলো সামেট ও নুরের বাহাস: উদারনীতি বনাম আদর্শবাদ।
নুরে মানুষকে আদর্শ ও ইতিহাসের অংশ মনে করে। সামেট মনে করে আদর্শবাদ মানুষকে সঙ্কীর্ণ করে তোলে। আর ইতিহাস তো মানুষেরই তৈরি। ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে, সেই রাতে ওঠা তুষার ঝড় স্তিমিত হয় নুরের বিছানায়। সামেট বহু পথ ঘুরে, বাস্তব-অবাস্তবের ঘেরাটোপ পেরিয়ে মিলিত হয় নুরের সাথে। সে যে গ্রামে শিক্ষকতা করতে এসেছে, সেখানে দুটোই ঋতু: শীত ও গ্রীষ্ম। তার জীবনেও যেন দুই ঋতু: সেভিম আর নুরে। ঘাসের উপর দিয়ে যেমন শীত ও গ্রীষ্ম চিহ্ন রেখে যায়, তার জীবনের উপর দিয়ে চিহ্ন রেখে যায় এক নারী ও এক চোদ্দ বছরের কিশোরী। জেলানের এই ছবি মনোস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও প্রকৃত অর্থেই চলচ্চৈত্রিক। মনটা ভরে গেলো। প্রায় সোয়া তিন ঘন্টার ছবি।
দেখা শেষ করে গেলাম উপরের তলায়, একেবারে ছাদে একটি ছোট ছেষট্টি সিটের প্রোজেকশন হল আছে, সেখানে মার্কেট স্ক্রিনিংয়ে প্রদর্শিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব’। বাবুল ভাই ফোন দিয়েছিলেন, ভাবলাম উনাকে একটা হ্যালো বলে আসি, পাশাপাশি ঢাকা থেকে আসা মন্ত্রী ও তারকার দুইচার কথা রেকর্ড করে পাঠাই সংবাদ প্রকাশে। আমি ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরেই অপেক্ষা করলাম। বিনা দাওয়াতে ঢোকা নিষেধ, তাই। তাছাড়া ভেতরে জায়গাও ছিলো না। তথ্যমন্ত্রী বেরিয়ে প্রতিক্রিয়া জানালে সেটা ভিডিও ধারণ করি। পরে দেখি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা আরিফিন শুভ বেরিয়েছেন। উনাকে বললাম কিছু বলুন। পরিচয় দিলাম, তার সাথে আমার আগেও দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। উনি বললেন, উনার স্মৃতি গোল্ডফিশের মতো। কি আর করা, অফিসের ওয়াস্তে গোল্ডফিশ মেমোরির আর্টিস্টকেও দাঁড় করিয়ে দুচার কথা ধারণ করে বিদায় জানালাম।
ঘড়িতে তখন দশটার উপর। চিন্তায় ছিলাম ট্রেন-বাস পাবো কি না। কিন্তু কানাডার যোগাযোগ ব্যবস্থার কৃপায় তা পাওয়া গেলো। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা আর কনকন🐼ে বাতাস। আমার কানে বাজছে: পাগল হাওয়া—কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে?