মেরি ছবি দেখছেন, এগিয়ে এলেন উজ্জ্বল হাসির সঙ্গে খলিল ‘আমার আঁকা ছবি আপনার ভালো লাগছে?’ তারপর একটু একটু করে জিবরান বুঝিয়ে দিলেন তাঁর আঁকা ছবির অব্যক্ত বাণী। তখনই ঈশ্বরের সিলমোহর আঁকা একটি অসাধারণ, অভাবনীয় বন্ধুত্বের জন্ম হলো। হয়তো ঠিক তখনি অদৃশ্য স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টিও হয়েছিল। আর সেই বন্ধুত্বের পরমায়ু আজীবন, আমৃত্যু। আমি সে কথা খলিল জিবরানের নানা প্রবন্ধে বলেছি।
বন্ধুত্ব পাকা হলো, ডালপালায় বিকশিত হলো, সুরভ♏িত হলো। দুজনে যখন দুজনের জীবনে একেবারে অত্যাবশ্যকীয় জরুরি ব্যাপার হয়ে উঠলেন, একদিন এক ছলছল সময়ে জিবরান তাঁকে প্রশ্ন করলেন—প্রাণাধিকা মেরি তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ মেরি একটুও না ভেবে উত্তর দিলেন, ‘না, খলিল। বন্ধুত্ব অনেক বেশি মূল্যবান। ভালোবাসা বা প্রেমের প্রহসনে অনেক বন্ধুত্ব প্রাণ হারায়। আর বিবাহ বন্ধনে শেষ হয় অনেক মহৎ সম্পর্ক।’ এরপর জিবরান আর কখনো উচ্চারণ করেননি বিয়ে নামের অপ্রাসঙ্গিক শব্দ। দুজনার গল্পের বিষয়বস্তু ছিল বড় সাধারণ। লেবানন, সিডারের বন, মা-বাবা, বোনেরা, আঁকা ও লেখার গল্প। ‘জানো মেরি সেই ছেলেবেলায় আমি যখন পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম...।’ এইমতো গল্প চলে। আর মেরি লক্ষ করে জিবরান ছেঁকে ছেঁকে ত🏅ুলে আনেন সেসব গল্প, যা বলতে তার আনন্দ, যা মনে করতে তার আনন্দ। সযতনে খলিল পরিহার করেন সেসব গল্প, যেখানে অভাব, মদ্যপায়ী বাবার হুংকার ও অত্যাচার নেই, মায়ের নীরব সহ্যশক্তির কথা প্রায়শই থাকে উহ্য। ইশ! সেই প্রাণের চেয়ে প্রিয় ফেলে আসা গ্রাম বসরি। যার কথা মনে করতেই হৃদয় ভরে ওঠে সিডারের ঘ্রাণে। যেখানে এসব থেকে পালিয়ে জিবরান ছবি আঁকতে যেতেন। ‘বাবা চেয়েছিলেন আমি আইনঙ্গ হব। মা চেয়েছিলেন আমার যা ভালো লাগে তাই আমি করব।’
মেরি এই দুজনার কথা ও সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে একবার তার জার্নালে লিখলেন— Not my age constitutes the objection, but the fact that for Khalil there waits a different love, and that shall be his marriage. His greatest work will come out of his greatest happiness, his nwe full life. Towards the woman of that love I am but a step.
কিন্তু মেরির এই ভাবনা একেবারেই সত্য ছিল না। কারণ, বিয়ে করার মতো কোনো সম্পর্ক জিবরানের কারও সঙ্গেই হয়নি। আপন গুহালোকের হারমিটেজে; আপন মনে বসবাস, আপন মনে লেখা, আপন মনে ছবি আঁকা। আর সময় পেলেই মেরিকে চিঠি লেখা আর মেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ। সুহৃদ ছিল তার মদ। প্রফেটের আলমিত্রা মেরি। একবারই জীবনে সে শিষ্যা। ভালোবাসা কি জানতে চাইলে প্রফেট বলেছিলেন মেরিকে—জীবনে যখন ভালোবাসা আসে তুমি তাকে অনুসরণ কর। যখন তুমি সত্যিই কাউকে ভালোবাস বলো না ঈশ্বর আমার হৃদয়ে, বরং বলো আমি এখন ঈশ্বরের হৃদয়ে। ভালোবাসার আশ্চর্য কোমলতা তোমাকে শেখাবে বেদনার্ত হতে। তুমি সানন্দে রক্তাক্ত হবে। আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে যার জন্য তোমার এত বেদনা, তারই মঙ্গল কামনায় একটু প্রার্থনা করবে।’ এমনি ভালোবাসাই তারা দুজনে দুজনকে দিয়েছিল। আর মেরির সহাস্য উদারতা জিবরানকে ভয়াবহ অভাব থেকে রক্ষা করেছিল। শুদ্ধ বাংলায় যার নাম টাকা, তাই দিয়েছিলেন তিনি অকাতরে প্রফেটকে। জিবরান কখনোই এই পরমা বন্ধুর কাছ থেকে কিছু নিতে আপত্তি করেননি। আর মেরি কী পেয়েছিলেন? ঐশ্বরিক এক অনুভব, যা মেরিকে সমৃদ্ধতর করেছিল। দুজনেই সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণ।
জিবরানের প্রিয় ছিল সমুদ্র। সময় পেলেই জিবরান ছুটে যেতেন সমুদ্রে। আর মেরি যেতেন পর্বতে। ‘ব্রোকেন উইংকস’ লিখবার পর উৎসর্গ করলেন মেরিকে। To her who gayes at the sun with fixed eyes, who touches the fire with the fingers that tremble not, who hears the songs of the absolute. To M.E.H I dedicate the book. Gibran.
এই উৎসর্গবাণীতে মেরি কেবল আনন্দে কেঁদেছিলেন। মেরি বলতেন, ‘জিবরান তোমাকে দেখলে আমার আনন্দ নয়, বেদনা হয়। কিন্তু সেই বেদনা উপাদেয়। আর সেই হরিৎ পানীয় আমি বারবার পান করতে চাই। মেরি নিজেই এই আনন্দ-বেদনার ককটেল, যাকে আমি প্রাণভরে ভালোবাসি।’ এই দুজনের সম্পর্কে খলিল নামের মানুষটি কি একবারও তার রক্তস্রোতে সেই চির পুরোনো রিপুকে একবারও অনুভব করেননি? একবারও কি মেরিকে টেনে নিয়ে যাননি গন্ধম ফলের নিষিদ্ধ জগতে? হয়তো গেছেন, হয়তো যাননি। সে নিয়ে গবেষণা করে কী লাভ? সে সময়ের কিছু আঁকা ছবিতে জিবরান এঁকেছিলেন মানুষ পশুর সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত প্রাণী। অনেকটা মাইনোটরের মতো। তবে তেমন ছবি মিস্টিক মানুষটি খুব বেশি আঁকেননি। থাক না সে পর্ব। চুলচেরা গবেষণা না-ই বা হলো। সেখানে গেছেন বা না গেছেন, সে নিয়ে ভাবনা করে কী লাভ? একবার খলিল জিবরান লিখছেন, ‘Sex energy has transformed into art production’। কেন বলেছিলেন? তার ব্যাখ্যা নেই। সৃষ্টিশীলতায় মন ঢেলে দিয়েছিলেন জিবরান। খুব বেশি ভাবেন সেই পর্ব, যা সেক্স নামে চিহ্নিত। অবশ্য পিকাসো বা সার্ত্রেকে যদি এমন কথা বলা হয়, তারা মৃদু হেসে বলবেন, ‘কেন দুটো কাজই তো একই সঙ্গে সম্ভব।’
মেরি বলতেন, ‘খলিলের এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তিনি কথায় আমাকে সতেজ করে তুলতেন। কথা, পাশাপাশি হাঁটা, বিবিধ বিষয় এমনকি খলিলের পাণ্ডুলিপি পঠন-পাঠন নিয়েই কেটে যেত তাদের বন্ধুত্ব-বিহার।’ খলিল লেখেন একবার, ‘জানো মেরি, মনে হয় ঈশ্বর আমার খুব কাছে বাস করছে। কারণ, তুমি যে আমার কাছে।’ মেরি বলেন, ‘আমারও তাই মনে হয়।’ আর এসব বলতে বলতে জিবরানের দুচোখ ভরে ওঠে অনির্বচনীয় কোমলতায়। জিবরান বলেন কেন তিনি ভালোবাসেন লিওনার্দো দ্য ভিনচিকে। বলেন, ‘জানো মেরি মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ঈশ্বর পুরুষ। কারণ, তার দাড়ি আছে। কিন্তু লিওনার্দো আঁকেন মানুষের মন। আঁকেন মোনালিসার রহস্য।’
জিবরান নিজে আঁকতে চান মোনালিসার সেই রহস্যময়তা, যার অর্থ করতে পারে না কেউ। সারা জীবনই তুলিতে, কলমে আঁকতে চেয়েছিলেন সেই অনির্বচনিয়তাকে, সাধারণ মানুষ কখনোই যার সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই ‘বিবলিকাল’ রহস্যময় শৈলী তাকে বিশিষ্ট করেছিল এই পৃথিবীর আর দশটা শিল্পীসত্তা থেকে। একবার সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন মেরিকে, ‘বলো মেরি তুমি কেন আমাকে এত টাকা দাও? খুব সহজ করে, সাধারণ করে বল যেন আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারি। একি উপহার না ধার?’ কিন্তু মেরি কখনোই এ প্রশ্নের উত্তর দেননি। একবার দুপুরের খাবার খেতে খেতে বললেন জিবরান ‘মেরি তুমি এই পৃথিবীকে খুব ভালোভাবে চেনো না। যেমন আমি চিনি। যেন চিরকালই এই পৃথিবী থেকে তুমি অনেক দূরে বাস কর। পৃথিবীতে ঠিকমতো জানা বুদ্ধিমানের কাজ। পৃথিবীর যূপকাষ্ঠে শহীদ না হয়ে বেঁচে থাকি আমরা। এই পৃথিবীর বিবিধ অনুষঙ্গে বেদনাবিদ্ধ না হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।’
জিবরানের স্টুডিও সাজাতে হবে মেরি গেলেন সেখানে। কাজ করতে করতে মেরি একসময় জিবরানের দিকে চোখ তুলে চেয়ে বলেন, ‘খলিল এক একসময় মনে হয় তুমি আমাকে রক্ষা কর, বাঁচিয়ে রাখো।’ জিবরান বলেন, ‘ভালোবাসার সহজ রূপটি আমাকে মুগ্ধ করে। যেন কোনো জটিল, আঠালো, প্যাঁচালো সম্পর্কে আমরা জড়িয়ে না পড়ি।’ এই কথার পর খলিল তাকে বড় কোমল করে চুমু খান। টেনডার অ্যান্ড সুইট। এ কোমলতা অনুভবের। স্বপ্নেরও কি সাধ্য আছে এমন কোমলতা তুলে আনে কোনো এক অচেনা বাগান থেকে। জিবরান একবার বলেছিলেন মেরিকে ‘মেরি আমার মুখ দেখলেই বুঝতে পারবে কী আছে আমার গহন গভীরে। কিন্তু এ সব সময় সত্যি নয়। সবকিছুই গোপন করবার ক্ষমতা ছিল জিবরানের চরিত্রে। বেদনা গোপন, ঔৎসুক্য গোপন, না পাওয়ার তৃষ্ণা গোপন। আর সব গোপনতা যখন তাকে বিবশ করে, হাতে তুলে নেন পানপাত্র। মেরি বলতেন, ‘আমি জানতাম তার একাকিত্বের যন্ত্রণা ও বেদনা। বলেছিলেন একবার, ‘মেরি তুমি না জেনে এমন করে আমাকে আঘাত কর, যা আর কেউ করেনি। এমন সব কথা বল, যা কোনো দিন আর কেউ বলেনি। সারা জীবন তুমি আমাকে যত দুঃখ দিয়েছ, তা আর কেউ দেয়নি। কিন্তু কেবল আমিই তো জানি ব্যক্তি মেরিকে, তার শক্তিকে, তাই কখনো ফুলস্টপ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এবং জানি তাঁর বিশাল প্রেম।’
নিজের স্টুডিওতে লুকিয়ে থাকা ছিল তার অন্যতম প্রিয় অভ্যাস। বলতেন, ‘এখন আমি এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। এখন আমি অন্য গ্রহের মানুষ।’
মেরি একবার চিঠিতে লিখলেন জিবরানকে ‘অনেক কাজ এখন তোমার সামনে। এমন কাজ কর তুমি যা তোমাকে শারীরিক ও মানসিক মুক্তি দান করে। তোমার আরাধ্য কাজে বিপুল ও বিশাল মানসিক শক্তির প্রয়োজন। ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। তোমার অন্তরের চিরশিশু তোমাকে পথ নির্দেশ করুন। সেই শিশুই বলে দেবে কোন পথ তোমার। আমি জানি ঈশ্বর আমাদের জন্য কিছু কাজ নির্বাচন করেন। সে কাজ আমরা অন্যের হাত থেকে নিই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমার কাজ আসে সরাসরি ঈশ্বরের হাত থেকে। এই কারণে এক অপার্থিব অলৌকিকতায় ঋদ্ধ তুমি। আজ পর্যন্ত তুমি যত কিছু করেছ সবকিছুই আমাকে গভীর আনন্দ দান করেছে। তুমি, তোমার কাজ, তোমার আনন্দ সবকিছুই আমার ভালোবাসার বিষয়। তোমাকে তোমার কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আর তোমার আত্মা মিশে থাকে সব কাজে। হয়তো তুমিই ঈশ্বর। তবু আমি সারাক্ষণ তোমার জন্য প্রার্থনা করি।’ উত্তরে জিবরান লেখেন, ‘এই পৃথিবীতে বড় কিছুর সাক্ষাৎ পেয়েছি, কাজেই আর সব সাধারণ ব্যাপার তাচ্ছিল্য করব, এমন ভাবনা আমার নয়। ‘গড অব স্মল থিংকস’ এবং ‘গড অব বিগ থিংকস’ সমভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আর একবার জিবরান লিখলেন মেরিকে ‘তুমি আমার আত্মার ভেতরে আর এক আত্মা তৈরি করেছ। মেরি আমি জানি আমার আগামীকাল আছে। কারণ, তুমি আছ। একবার খুব যত্ন করে, আদর করে মেরি জিজ্ঞাসা করলেন জিবরানকে ‘সত্যিই কি কাউকে তোমার জীবনসঙ্গিনী করতে ইচ্ছে করে না? উত্তরে বলেছিলেন জিবরান ‘কাজ, জীবনযাপন, জীবনদর্শনের জন্য কেউ সঙ্গে থাকা ভালো। কিন্তু সে নিয়ে ভাবিনি। কারণ, তুমি আছো।’
মেরি বিয়ে করেছিলেন বড়লোক, বেশি বয়সের ফ্লোরেন্স মিনিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন জিবরানকে, ‘খলিল এরপরেও কি আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে? আমি তো বিয়ে করলাম।’
‘থাকবে। তুমি যদি এরপর আরও সাতবার বিয়ে কর তারপরেও।’
১৯৩১ সালের ১২ এপ্রিল জিবরান মারা যান। তারপর আরও ৩৩ বছর বেঁচে ছিলেন মেরি হাসকেল। তার কাজ তখন একটাই। প্রিয় বন্ধুর লেখা পরিমার্জনা, সম্পাদনা, ছাপানো। সংরক্ষিত রাখা সেসব, যা সংরক্ষিত রাখা প্রয়োজন। এসবই করতেন জিবরানের জীবদ্দশায়। সবকিছু লিখে মেরিকে পাঠিয়ে বলতেন, ‘তুমি না দেখলে ভরসা পাই না। সে কথা মেরি সহচরী কী করে ভুলে যায়? ১৯৬৪ সালের ৭ মে মারা গেলেন মেরি। লিখে গেলেন ‘মৃত্যুর পর কোনো ফিউনারাল সার্ভিসের প্রয়োজন নেই। আমার শরীর ক্রিমেশনে বিলুপ্ত হবে, এই আমি চাই। ছাই সংরক্ষণের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার নাম লেখা যেতে পারে আমার স্বামীর কবরে। লেখা হবে আমার নাম “মেরি এলিজাবেথ হাসকেল”।’
জার্নাল থেকে পাওয়া মেরির একটি চিঠির অনুবাদ এমন হতে পারে—ভালো আছ তো বন্ধু আমার। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে নিজের বি✨য়ের পর, নিজের সংসার থেকে লিখছেন মেরি
খলিল
অনেকগুলো প্রশ্ন মনে জমে আছে জানো। তোমার জিসাসের গল্প কেমন হলো? শীতে তুমি কেমন ছিলে? তোমার কোনো খবর পাচ্ছি না। খুব তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে আমাকে সব জানাবে। জানাবে গত দুই সপ্তাহে তুমি কেমন ছিলে? বস্টন না নিউইয়র্ক কোথায় অবস্থান করছিলে তুমি?
খলিল তুমি যদি এখানে আসতে পারতে দেখতে কী অপূর্ব বসন্ত। আর এখানকার শীত অন্যমতো। আমার চারপাশের পৃথিবী সবুজ সমুদ্রের মতো। যেখানে ক্রমাগত ঢেউ উঠছে আর পড়ছে। সূর্য অনেকটা সাদাটে বলের মতো। ছায়া কখনো তমসাচ্ছন্ন। আপাতত বৃষ্টি নেই। সারা শীতে পাখির ডাক শুনেছি। দুই দিন আগে চার্লস্টনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানকার নিসর্গ মনোরম। দু-একটি বাগান আছে। ম্যাগনোলিয়া বাগান ও মিডলটন বাগান। আবহাওয়া মোলায়েম ও চমৎকার। পাম, ম্যাগনোলিয়া, সজীব, সতেজ ওক, দীর্ঘ পত্রছত্রের পাইন, পপলার, আরও নানা বৈভবী বৃক্ষে পরিপূর্ণ সবকিছু। আর এসব গাছপালা যে গভীর রহস্য রচনা করেছে, তা তুলনাহীন। চারপাশের মস কী অপরূপ! এখানে এলে মনে হয় আমি এক অন্য জগতে চলে এসেছি। ‘রোমান্স’ শব্দটি থির হয়ে আছে গাছপালায়। কেনো জানি হ্রদয়ে বেদনা জেগে ওঠে। মনে পড়ে এমনি বনান্তভূমিতে তুমি আর আমি কেন নেই, কেন একা আমি একই গ্রহলোকের অধিবাসী তারপরেও। এর যতই গভীরে যাই বুঝতে পারি এর সৌন্দর্য আর গভীরতা। এই সৌন্দর্যে আমার অন্তর ডুবে যায়। আমি থির হয়ে উঠি।
আমাদের শীত ভালোই কেটেছে। এ বছর ফ্লোরেন্স ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগেনি। ঘরের কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে। বাড়িতে একজন ভালো রাঁধুনি পাওয়া গেছে। ও আমাকে রান্নায় সাহায্য করে। ফ্লোরেন্সকে নানাভাবে সাহায্য করা ছাড়াও আছে অন্যান্য টুকিটাকি। কত বড় বাড়ি এটি। সাজিয়ে, গুছিয়ে রাখাও এক বিরাট ব্যাপার।
সেলাই আমার পছন্দ। কখনো অবসরমতো চুপচাপ সেলাই ভালো লাগে। সঙ্গে সেলাই রাখি। একেক সময় অন্যের চোখের সামনে বই খুলে রাখা অভদ্রতা। পড়ি যখন কেউ থাকে না। যখন একা। পড়তে পড়তে অনেক সময় কেটে যায়।
কিছুদিন আগে আলাবামা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। খাবার ঘরে তোমার আঁকা একটি ছবি ঝোলানো ছিল। ভদ্রমহিলা সেই ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছবি দেখে আমার একজন শিল্পীকে মনে পড়ছে। এ ছবি ঠিক জিবরানের আঁকা ছবির মতো। তুমি কি জিবরানকে জানো?’
আমি ওঁকে ওপরতলার ঘরে নিয়ে গেলাম। দেখালাম ওকে তোমার আঁকা সাতাশখানি ছবি।
চিঠি বড় হলো। পরে আরও লিখ। তারপর আরও। ১০টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমার সব কাজ শেষ হয়। বাড়িতে একজন বৃদ্ধা আছেন। আমার কাজ তাঁকে একটু দেখাশোনা করা। তিনি দিনে একবার বাইরে যান তার ছেলের কাছে। তখন এক ঘণ্টা পনেরো থেকে বিশ মিনিট আমার একার।
আর আমার সেই একান্ত নিঃসঙ্গ সময়ে আমি তোমাকেই চিঠি লিখি। তখন তোমাকে লিখতে, তোমাকে নিয়ে ভাবনা করতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। আমার নিঃসঙ্গ সময় তোমার অনুভবে ভরে থাক। সেখানে আর কেউ থাকবে না। সে সময় ও সুঘ্রাণ আমার একার।
ভালোবাসা জানিয়ে শেষ করছি।
তোমার মেরি।
যখন এই পৃথিবীর কাজ শেষ করে মেরি যখন যান আর এক পৃথিবীতে, ধারণা করি অপেক্ষমাণ জিবরান হয়তো হাত বাড়িয়ে বলেছেন ‘আয় তবে সহচরী।’
অনন্তলোক ওদের কখনো বিচ্ছিন্ন করবে না।