মরিচশাল ধান থেকে ভালো খই হয়। খুব শীত। লেপের ভেতর থেকে বেরোনো যাচ্ছে না। আগের দিনের বাসি পায়েস এক বাটি তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে শ্যামল বাঙাল। গোরুর দুধ প্রচুর হয়ে গিয়েছে। ঘোল করে খাচ্ছে। দই করে খাচ্ছে। চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। শেষ আর হয় না।
মাছ হয়েছে পুকুরে। সাতশো-আটশোর মাগুর। বউ ইতি রান্না করে দিচ্ছে সকালে। ভেজে দিচ্ছে। দুপুরে আবার মাছ রান্না। বাড়ির সামনের খালে ধরা পড়েছে জ্যান্ত কই। বিকেলে কাঁকড়া। চাষিরা ক্যানিংয়ের দিক থেকে আসছে। বাবু, মদ𒉰 আনাও। উঠোনে চুলো ধরিয়ে তারা কাঁকড়া আগুনে পুড়িয়ে নিচ্ছে। তিন-চারশো গ্রাম ওজনের এক একটা।
খুলনা জেলা স্কুলের সাধু কালাচাঁদ ওরফে শ্যাম মৌলিক ওরফে অসাধ্যসাধন গাঙ্গুলি। এক একজন মানুষের জীবন এক একটি মহাকাব্য। বেঁচে থেকে কেউ তা আবিষ্কার করে। অন্যজন ফেলে ছড়ꦇিয়ে কাটিয়ে দেয়। একজন আর্টিস্ট জীবনের রস জ্বাল দিয়ে সেরা পাটালি তৈরি করবেন— শিল্পে বোধহয় এরকম ঘট♍ে। যা ঘটে তা শিল্প নয়, যা ঘটলেও ঘটতে পারে তা-ই শিল্প। এই বিশ্বাস থেকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের এক জীবনকে ভেঙেচুরে আরও অনেক জীবনের মধ্যে ভরে দিয়েছেন বারবার। ভিয়েন চাপিয়ে বড় কারিগরের মতোই চুপচাপ ওয়েট করেছেন লেখার জন্য। কোনও একটা ফ্রেমে বাঁধানো জীবনের দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে বসে ছিলেন না।
মানুষের আয়ু কিছু অফুরন্ত নয়। অথচ স্বপ্ন অনেক। সংগীতে, খাদ্যে, বই পড়ায়, মেশামেশিতে আহ্লাদটুকু চেঁছেপুঁছে তুলে নিতে হবে— এমন বিশ্বাস করতেন শ্যামল। প্রতিদিন নতুন আবিষ্কারের মধ্যে থাকতে চাইতেন। বাজারে গিয়ে পছন্দমতো মাছ, সবজি কেনা, দোকানিদের সঙ্গে ভাবসাব, সাইকেল চড়া, ইতি কাকিমাকে হরেক রান্নার ফরমায়েশ— এসবই তাঁর বাইরের দুনিয়ায় ভেসে থাকার মতো। যখন যা লেখেন, তার মধ্যেই বসবাস করেন। লেখা শেষ হলে পড়ে দেখেন না। ভুলেও যান।
তিনিই বলতে পারতেন— “লিখতে শেখার আগে খেতে শেখো। ঘুমোতে শেখো। গান শুনতে শেখো। চায়ের দোকানের বেঞ্চে চুপচাপ গেলাস নিয়ে বসে লোকের কথা শোনো। লেখা আপনি হবে।”
তাঁর নিজের লেখায় তো পেয়ে যাই তেমনই কথা— “সে এমন কিছু জিনিস দেখতে পায়— যা আর কেউ পায় না। অনেক পরে বুঝেছিলো— এই পুরো ব্যাপারটার নাম হলো— দৃষ্টিভঙ্গি। বা দেখার চোখ। একই পৃথিবী সবার চোখের সামনে। লেভেলক্রসিং। হিমসাগরের ডাঁই। পাকা কাঁঠাল। লোকাল ট্রেন। রিকশ সাইকেলের প্যাঁক প্যাঁক। পায়ে পায়ে বর্ষাকালের জলকাদা। এর ভেতরেও মানুষের একটা রূপ ফুটে ওঠে। অসমান সব পায়ে কত রকমের গতি। বেগ। এবং আবেগ। দেখতে জানলেই দেখা যায়। এই দেখা কেউ শেখায় না। দেখতে দেখতে শেখা। জীবন হতে হতে জানা। (অলীকবাবু)
তিনিই লিখতে পারতেন এভাবে— “শিশু বয়সে ঘুনসি লটকানো বালক মাত্রই ভালোবাসার পুতুল। ক্রমে ক্রমে ভদ্রতা, আব্রু ইত্যাদি মানুষকে আক্রমণ করে পরাভূত করে ফেলার পর খড়ের ভেতর দিয়ে আমরা শুধু মাথাটুকু জাগিয়ে রাখি। রোজ ভদ্রতায় আক্রান্ত, আবরণীতে আবৃত পৈত্রিক নামে চিহ্নিত— আমরা এক একটি মানুষ তলিয়ে যাচ্ছি। হাতের চেটোতে মুখ মুছি না— রুমালে মুখমণ্ডল মার্জনা করি। ফলম তথৈবচ।
আমার বুকের ভেতর আত্মার ভেলাটি এক বালতি রক্তে টালমাটা🌠ল হয়ে ভাসছে। আরও কতকাল ভাসব। অন্ধকার হয়ে এলে লাল🍎 রক্তে কালো ছায়া পড়ে। তারপর সেখানে স্নিগ্ধ নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলোয় তুমি কি হাঁটু রক্তে দাঁড়িয়ে আমার ভালোবাসাবাসির সঙ্গে মেশামেশি করতে পার। আমার নামই আমার সম্পত্তি। আমার নামই আমার দায়িত্ব। ব্রহ্মাণ্ডে সে দায়িত্ব সমিতিবদ্ধ, সেখানে মেশামেশি ভালোবাসাবাসির দর ওঠানামা করে না। সবই নিস্তরঙ্গ গভীর অতল।” (নির্বান্ধব)
সব কিছুর মধ্যেই জীবনবোধ, মেধা, স্মৃতি, দর্শন, পর্যবেক্ষক মন আর কোনও এক ঘোর থেকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আশ্চর্য জগৎ বুনেছেন। যে পাগলামিতে তাঁকে ধরা যায় না তা-ই লেখার সময় দৈবী পাগলামিতে বদলে যায়। ইতিহাসের সব ঘটনাই সময়ের কাছে এক একরকম হয়ে দাঁড়ায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার স্বরূপটি বুঝেছিলেন। তাই পাঠকের হাত ধরে তাকে জাদু পৃথিবীর মাঝখানে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন ম্যাজিশিয়ান শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।
বলতেন, “নতুন যারা ত🌠ারা কি আমাদের লেখা পড়বে আর? মজিয়ে রাখার মতো লেখা লিখতে পারিনি। আমাদের যৌবনে আমরা যাঁদের লেখা পড়ে ভালো বলতাম, আলোচনা করতাম, তাঁদের অনেকেই তো মুছে গেছেন।𒁏 আমারও কি সেই দশা হবে না?”
শ্যামলবাবু, আপনার পাঠক যাঁরা, তাঁরা আপনাকে খুঁজে নিয়ে পড়েন। পড়বেন। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের বিপরীতে লেখক এক নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। সেখান থেকে তাঁর উড়িয়ে দেওয়া পাখি কখনও দূরে মিলিয়ে যায়, কখনও ফিরে হাতে এসে বসে। রোজকার জীবনের বাস্তবভূমিতে অথচ সংগীত, খাদ্য, বন্ধুবান্ধব, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তাঁর মাথার ভেতরে বয়ে চলে। সেখানেই বিমূর্ত সৃষ্টির ভারা বাঁধতে থাকেন তিনি কোনও এক রাজমিস্ত্রির মতো। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় খানিকটা ব্যাখ্যা বোধহয় করা যায় এভ𒁃াবে। খানিকটা, কারণ তাঁর লেখার আরও অনেকখানি শীতের কুয়াশায় রহস্যময় জ্যোৎস্না। পাঠক হিসেবে তার জ্যামিতিক আলো-আঁধার আবিষ্কারের দায়িত্ব বর্তায় আমাদের ওপর।