আবেগ-আন্তরিকতা আর ভালোবাসা মিশ্রিত একটি আয়োজন হয়ে গেল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের শংকরে ছায়ানটের প্রধান মিলনায়তনে; বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ১০টা অবধ🍸ি চলে সে আয়োজন। ইপসার সহায়তায় এবারের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। কবিতা উৎসব আয়োজনই সমধারার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়; সমধারার উৎসবে অংশ নিয়ে মনে হলো, উৎসবে যেন স্বপ্নেরই ছড়াছড়ি; অবশ্য স্বপ্নের বিষয়টি সাদা চোখে কারো চোখে পড়ার কথা নয়; সেটি হৃদয়ঙ্গম করার বিষয়। স্বপ্নাকুতিগুলো ততটা দৃশ্যমান নয়, স্বপ্নগুলো লতিয়ে ওঠে প্রতিটি কার্যক্রমের সার্বিক উপস্থাপনায়।
আমরা যারা দেশমাতৃকাকে নিয়ে ভাবি, যারা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের অগ্রযাত্রার কথা ভাবি, যারা বাঙালির সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই; যারা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আস্থা রাখি; যারা ধর্মান্ধতা-কূপমণ্ডুকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ থেকে জাতিকে নিরাপদ রাখতে চাই; যারা বাংল♑ার আবহমান কালের শাশ্বত বাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ অথবা ‘হাজার বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।’ এসব সত্যে আস্থা রাখি, তারা নানান কৌশলে অতীত ঐতিহ্যের✱ শৌর্য-বীর্যের গৌরব ফিরিয়ে আনতে চাই; কিন্তু হায়! মানুষ কখনো অতীতে ফিরে যেতে পারে না— তর্পণ করতে পারে মাত্র; সময়ের বাস্তবতায় আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, সেখানে সবার প্রত্যাশিত উজ্জ্বল অতীত ফিরিয়ে আনা স্বাভাবিক অবস্থায় দুর্লঙ্ঘ নয়, অলঙ্ঘই বলা যায়। সবার প্রত্যাশা পূরণে সর্বৈব এক বিপ্লব অত্যাবশ্যক। আমাদের এই অতীত ফিরিয়ে আনার কলাটি উপলব্ধির; যার অন্তরে স্বপ্ন লুক্কায়িত থাকে। সমধারার দীর্ঘ কর্মতালিকায় দেখতে পাই অতীত গৌরব তুলে আনার প্রয়াস; হয়তো সে কারণেই সমধারা আমাদের ভাষা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করে।
১৯৭১-এ যে জাতি বঙ্গবন্ধুর এক তর্জনীর মাথায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল; যে জ🥀াতি ৩০ লাখ মানুষের বুকের রক্ত, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম আর দীর্ঘ যন্ত্রণা সহ্য করে স্বাধীন করেছিল দেশ; সেই জাতি স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত এক মহান নেতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে, কলঙ্কিত করেছে ইতিহাস; ১৯৭৫-এর পর যে জাতি দীর্ঘ একুশ বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্তির লজ্জা মাথা পেতে নিয়েছে। যে জাতি আজ বহুধা বিভক্ত; যখন আমাদের সꦦ্বার্থের সমুখে নীতিবোধ অবনত; তখন সবার প্রত্যাশা কীভাবে পূর্ণ হবে, হয়তো আমরা তা জানি না; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতার শরণাপন্ন হয়ে নিজেদের কলঙ্ক মুছতে চাই; এ-ও আমাদের স্বপ্নের এক অধ্যায়; যদি পেছনে তাকাই দেখতে পাই, ইতোমধ্যে সমধারা যে ৮৯টি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করেছে, তার বেশ ক’টির প্রচ্ছদ হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর সংগ্রাম এবং আদর্শ বয়ান।
আমাদের লড়াই-সংগ্রাম একদিনেই শেষ হয়ে যায় না; কিন্তু জাতির অগ্রযাত্রা এবং শুভ প্রবণতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য নিয়ত কাজ করে যেতে হয় স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে; তারপরও ‘যতক্ষণ শ্বাস— ততক্ষণ আশা!’ শুভ চেতনার কথা আমাদের বলে যেতে হয়। আজ আমরা এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে সত্য উচ্চারণ করতে চাই, যখন আমাদের সমাজ-পরিপার্শ্ব স্তূতি আর স্তাবকতায় নিমজ্জিত। যখন ব্যক্তি স্বার্থের কাছে মূল্যবোধ বিপন্ন! কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি সংস্কৃতিকর্মীরাই পারে মানুষের কল্যাণ চিন্তায় স্রোতের বিপরীতে উজানে চলতে। শুভ চেতনার পক্ষে সবাই সক্রিয় থাকতে চাই নিরন্তর। সমধারা সে কাজটিও করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সঙ্গে। স্বপ্ন-বাস্তবতার ক্ষেত্রে সমধারা হয়তো সবার প্রত্যাশা সমভাবে পূরণ করতে পারছে না; কিন্তু তাদের আন্ꦰতরিকতায় যে সামান্য ঘাটতি নেই সে কথা স্পষ্ট হয় সমধারার নানা আয়োজনে।
সমধারার আয়োজন এবং কর্মসূ💛চি যদি সামান্য যত্ন নিয়ে দেখতে চাই, তাহলে দেখব— সাহিত্যের কাগজ সমধারা নিয়মিত প্রকাশনার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণা, অবহেলিত শিশুদের স্বাক্ষরজ্ঞান প্রদানসহ সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে; যার সঙ্গে আছে স্বপ্নের যোগ। যে আয়োজনের কথা বলতে গিয়ে এত কথার অবতারণা, সেটি ছিল ‘ইপসা সমধারা ৯ম কবিতা উৎসব ২০২৩’। মোট চারটি পর্বে বিন্যস্ত উৎসবের প্রথম পর্বে ছিল পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অর্ধশতাধিক কবির স্বকণ্ঠ স্বরচিত কবিতা পাঠ; প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি নজমুল হেলাল। দ্বিতীয় পর্বে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে আবৃত্তি পরিবেশনা; সালেক নাছির উদ্দিন-এর গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় ‘গুণের সবুজ ফসল’ আবৃত্তি পরিবেশন করে সমধারার নিজস্ব আবৃত্তি দল। টান টান উত্তেজনার মধ্যে একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করে যায় বাচিকশিল্পী দল; স্বল্প ধারাবর্ণনার অংশটুকুও ছিল সাবলীল এবং আকর্ষণীয়। দুই শতাধিক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে স্বয়ং কবি নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন এ পর্বের মুগ্ধ শ্রোতা; কবি তার মুগ্ধতার কথা উচ্চারণ করলেন পরিবেশনা শেষে। তৃতীয় পর্বে ছিল সমধারা সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রদান। কথাসাহিত্যিক কাইয়ূম নিজামীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তৃতীয় পর্বটি ছিল প্রাণচঞ্চল। মুহুর্মুহু করতালি আর হর্ষধ্বনির মধ্যে এবারের পুরস্কার পেলেন কথাসাহিত্যে হরিশংকর জলদাস, কাব্যসাহিত্যে ফরিদ আহমদ দুলাল এবং শিশুসাহিত্যে স.ম শামসুল আলম। পুরস্কার প্রাপকদের হাতে নগদ অর্থ, পোট্রেট এবং উত্তোরী তুলে দেন কবি নির্মলেন্দু গুণ ও অতিথিবৃন্দ। এ পর্ব উদ্বোধন করেন কবি প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন সমধারা সম্পাদক সালেক নাছির উদ্দিন। উল্লেখ্য, নবীন কবিতাকর্মীদের সংগঠিত করার পাশাপাশি খ্যাতিমানদেরও সম্মানিত করার স্বপ্ন নিয়েই সমধারা ১৯১৬ সাল থেকে প্রবর্তন করে সমধারা সাহিত্য পুরস্কার। প্রথম কয়েক বছর শুধু কবিতার জন্যই এ পুরস্কার প্রদান করা হলেও কয়েক বছরের মধ্যে যুক্ত হয়েছে শিশুসাহিত্য ও কথাসাহিত্যও। ইতোপূর্বে যারা এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তারা হলেন কবি হেলাল হাফিজ (২০১৬), কবি নির্মলেন্দু গুণ (২০১৭), কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা (২০১৮), কবি মৃণাল বসুচৌধুরী (২০১৯), কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ (২০২০), কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ও কবি সরোজ দেব (২০২১), কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও কবি ওমর কায়সার (২০২২)। সমধারা পুরস্কারের🌳 দিকে তাকালে দেখতে পাই, প্রথম চার বছর কবিতার জন্য একজনকেই এ পুরস্কার দেয়া শুরু হলেও পঞ্চম বর্ষে ঘটে যায় বিপর্যয়; না, বিপর্যয় পুরস্কার একজনের পরিবর্তে দুজনকে দেয়ায় নয়; বিপর্যয় ঘটে পঞ্চম বর্ষে কবিতায় কাউকে পুরস্কারই দেয়া হয়নি; কবিতা উৎসবে কবিতাই পড়ে গেল বাদ; অসাবধানতায় কখনো এমনটি হয়ে যায়; পরবর্তী বছরই ভুল সংশোধন করে নিয়েছে সমধারা। অষ্টম বর্ষ থেকে তিনটি শাখায় পুরস্কার প্রদান শুরু হলো; ২০২৪-এর জন্য ইতোমধ্যেই যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে পুরস্কার পাবেন তিনজন কবিতায় মজিদ মাহমুদ, কথাসাহিত্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী এবং শিশুসাহিত্যে ধ্রুব এষ। সমধারা যেহেতু স্বপ্নবুনন কাজেই মগ্ন, আগামীতে যদি এ পুরস্কার সাহিত্যের চার-পাঁচ বা ছয় শাখায়ও প্রদান করা হয় তবে আমি অন্তত অবাক হবো না।
পুরস্কার 𒆙বিতরণ শেষে সাইক সি🦹দ্দিকীর গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় অভিনীত হয় ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে পালা— ‘জয়তুন বিবির পালা’। লক্ষ করলে দেখা যাবে পালা নির্বাচনেও আছে স্বপ্নের আভাস; শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম, নিজেদের ঐতিহ্য ও গৌরব তুলে আনার প্রয়াস; পালা উপস্থাপনের মাধ্যমে সমধারা যেন নগরের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলো লোকবাংলার ঐতিহ্যবাহী পালাগানকে।
নবম কবিতা উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত হয় সমধারা-৮৯ বিশেষ সংখ্যা। এ ছাড়াও সালেক নাছির উদ্দীন ও জান্নাত আরা মমতাজ সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘পদাবলীর যাত্রা’। এবারের পদাবলীর যাত্রায় সংকলিত হয়েছে কবি ফরিদ আহমদ দুলালের ভূমিকাসহ শতাধিক কবির কবিতা; আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ꧃ এঁকেছেন শামীম আশরাফ। এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয় সম্প্রতি প্রয়াত কবি সোহাগ সিদ্দিকীকে; যিনি সমধারাসহ সাহিত্যের নানান আঙিনায় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। সাহিত্যাঙ্গনে সমধারা আগামীতে আর কী নতুন স্বপ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়, তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা। আসুন আমরা ভালোবাসা নিয়ে সমধারার পাশে দাঁড়াই, দাঁড়াই স্বপ্নের পাশে।