আত্মজীবনী হচ্ছে স্বরচিত জীবনচরিত। বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও আত্মজীবনী এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। স্মৃতিকথামূলক লেখা সেই আত্মজীবনীরই অংশ। মানুষ জীবনকে পাঠ করতে চায়, এক জীবনকে পাঠ করে অনেক জীবনের পরিচয় পেতে চায়।
‘স্মৃতির খেয়ায় যাই ভেসে যাই’ কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্মৃতিকথামূলক বই। শক্তিশালী এ কথাসাহিত্যিক তাঁর শ্রদ্ধেয়-প্রিয় ও ভালোবাসার কয়েকজন মানুষকে নিয়ে লিখেছেন এ স্মৃতিকথা। তাঁরা হলেন এস এম সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, ফজলে হাসান আবেদ, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, হাসান আজিজুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, যতীন সরকার, শান্তনু কায়সার, আবুল হাসনাত, জাকির তালুকদার। গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্মৃতি সাবলীলভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
কথাশিল্পী আনোয়ার সৈয়দ হক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কলাম, মনোবিশ্লেষণমূলক রচনা, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণকাহিনি, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার বিচিত্র মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, আবু রুশ্দ কথাসাহিত্যিক পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং রাষ্ট্রীয় একুশে পদক পেয়েছেন। তিনি পেশায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনোবিজ্ঞানী, নেশায় আদ্যন্ত লেখক। স্মৃতিকথামূলক বই তিনি এর আগেও লিখেছেন। তবে ‘স্মৃতির খেয়ায় যাই ভেসে যাই’ ব্যতিক্রমী। বইটিকে তিনি দুটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত বিষয়গুলো এনেছেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের দিনরাত, স্মৃতিময় বাংলা একাডেমি এবং দুই কালের দুই বইমেলার আন্তরিক গল্পকথা। তাঁর লেখার আলাদা ধাঁচ রয়েছে। সহজভাবে উপস্থাপন করেন; কিন্তু সত্য উন্মোচিত হয়। যেটি তাঁর লেখা পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায়। তিনি যাঁদের স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন, তাদের সাহিত্যবোধ, মান নিয়েও আলোচনা করেছেন। তাদের সৃষ্টির প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে তরুণ কয়েকজন ব্যক্তির কথাও এসেছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গি উদার-প্রসারিত।
‘গল্পকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’ নিবন্ধে তিনি প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্প লেখার হাতও যে দারুণ, সে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা গল্পের বই ‘ভালোমানুষের জগৎ’-এর নয়টি গল্প কেন পাঠক মহলে সমাদৃত, তা এ নিবন্ধটি পাঠ করলে উপলব্ধি করা সম্ভব। তিনি বলেছেন, ‘সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্পের বইটির নাম ভালোমানুষের জগৎ। নয়টি গল্পের সমাহারে এই বইটি সজ্জিত। অধিকাংশ গল্পগুলোর ভেতরে আছে মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে আদর্শের সংঘাত এবং জীবনের বাস্তবতার কাছে সেই আদর্শের মাথা নত হয়ে যাওয়া। শুধু বাস্তবতা নয়, মানুষের মনের লোভও সেই পতনের মূলে।’
কথাশিল্পী তাঁর স্মৃতিকথায় লেখকদের মনোজগতের বর্ণনাটা দিয়েছেন চমৎকারভাবে। সেখানে জটিলতার ছাপ নেই। রয়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে বহিঃপ্রকাশ করার দুরন্ত প্রয়াস। তাঁর স্মৃতিচারণায় বাংলাদেশের ইতিহাসের হেঁটে চলা এসেছে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারের উত্থান ও স্বৈরাচারের পতন- একের পর এক ঐতিহাসিক স্মৃতি। সব মিলিয়ে এটি দাঁড়িয়েছে স্মৃতিদেহ হিসেবে। যার অংশীদার স্বয়ং তিনি। এ বয়সে এসেও স্মৃতি হাতড়ে লিখে যাওয়ার মতো দুঃসাহস কজনেই-বা করেন!
‘কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই : চেনা ও পড়া’ নিবন্ধে লেখকের লেখকসত্তা এবং ব্যক্তির বিশালত্ব নিয়ে লিখেছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। বড় দুঃসময়ে যে বা যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের একজন হাসনাত আবদুল হাই। অথচ সে সময় কত চেনামুখ অচেনা হয়ে গেল, অদেখা মনোভাব তৈরি করে দূরে সরে গিয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বেভুল হয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াই। গাড়ি ধরে চলে যাই দূর দূর সব জায়গায়। অচেনা অজানা জায়গায়। রাস্তার ধারে আড়াল খুঁজে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। আবার রস্তার ধারেই গাড়ি থামিয়ে অচেনা দোকান থেকে চা বিস্কুট কিনে খাই...।’ তখন তিনি সঙ্গীহারা। জোড়াহারা পাখিরা যেমন অস্তিত্বহীন পড়েন, ঠিক তেমন এক অবস্থার মধ্যে কিছু মানুষ ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যা তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্মৃতিকে তুলে ধরেছিলেন হাসনাত আবদুল হাই, তাঁর রচিত ‘হেমিংয়ের সঙ্গে’ গ্রন্থে। বইটি প্রকাশের পর অনেকের রোষানলেও পড়েছেন তিনি। সত্যকে আড়াল করতে একদল আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্য যে লুকোনো যায় না, সত্য বড়ই নির্মম। তিনি এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘...আমি তাদের বোঝাতে পারলাম না যে জীবনের সত্য কোনো দিনও হারিয়ে যায় না, যাওয়ার মতো নয়, আর সাহিত্য মানুষের জীবন-সত্য নিয়ে কথা বলে। তাই বলে পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, রক্তের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, কারণ আমি আমার রক্তের ভেতরেই সেই অঙ্গীকার বহন করে বেড়াচ্ছি এবং মাথা উঁচু করে খুব গর্বের সঙ্গেই বহন করে বেড়াচ্ছি।’
কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক জীবনের কোনো এক ক্ষেত্রে কারও ভালোবাসা, হৃদয় নিংড়ানো স্নেহ পেলে তা মাথা পেতে নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মনোভাব রেখেছেন। এ গ্রন্থটি তারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি হয়তো চেয়েছেন- মানুষ জানুক আমার সংকটের সময়ে বন্ধুদের কথা, ছোট-অগ্রজ এবং অনুজদের কথা। যেখানে নেই কোনো রাখঢাক। রয়েছে ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ করে রাখার বিশাল উদারতা।
স্মৃতির বইমেলা নিয়ে তাঁর লেখা নিবন্ধে তিনি ভাঙা-গড়ার বর্ণনা দিয়েছেন। একটি বইমেলা কীভাবে গড়ে, আবার ভাঙে। তার চিত্রপট তুলে ধরেছেন। বিশালত্বে রূপ নিয়েছে বইমেলা। ছোট্ট থেকে বড়। কিন্তু তার ভেতরে তিনি খুঁজেছেন দৈন্যতা। বইমেলার সঙ্গে মানুষের মুখের ভাষা, ভাষার সচেতনতার, দেশের ঐতিহ্য, জাতির ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে রয়েছে সম্মিলন। কিন্তু সেই মেলা শুধু বৈষয়িক হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা যায়। যেখানে বড়দের দৌরাত্ম্যে ছোটরা ছিটকে পড়ছে। কমছে প্রেয়সীদের আনাগোনা। হেলেদুলে ঘুরে বেড়ানো। যৌবনের কিছু স্মৃতি নিয়ে যারা ঘুরে বেড়াতেন এই মেলায়, তাদের স্মৃতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বেদনার ফুলঝুলি ভারী হচ্ছে। এ যেন একমুঠো চাঁদের আলো পাওয়ার মতো অনুভূতি ছিল। যে বইমেলায় সবচেয়ে খুশি হত তরুণ-তরুণীরা, সেখানে আজ তারা বইবিমুখ। তিনি স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘বইমেলা সামান্য, খুবই সামান্য একটু সুযোগ করে দেয় তরুণ কবি সাহিত্যিকদের। এর ভেতরে তাদের আশা, উদ্দীপনা, সাহিত্য আলোচনা, নির্দোষ ঠাট্টামস্করা, লেগপুলিং সব থাকে জড়িত।’
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের বইমেলা নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি যে হতাশায় নিমজ্জিত হলেন। কখন এতগুলো বসন্ত পার হয়ে গেল, তা যেন হঠাৎ করে টের পেলেন। পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে নিজেকে ভাবতে লাগলেন। সে সময় লেখকের প্রতি ছিল বিশেষ কদর। স্টলের ভেতর ছিল বসার জায়গা। লেখকদের আড্ডা। সেগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘...তখন নবীন কবি এবং নবীন লেখকেরা নিজের পয়সায় বই বের করে কোন স্টলের জোগাড় করতে না পেলে মাঠে ঘাসের শয্যায় প্লাস্টিকের চওড়া অয়েলক্লথের ওপরেই বিছিয়ে দিতেন তাদের বই। সেসব স্টল ঘিরে বসে আড্ডা দিতেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, রবীন্দ্র গোপ, ফেরদৌস নাহার, শামীম আজাদ নামের অতিশয় তরুণ কবিরা...।’
‘স্💎মৃতির খেয়ায় যাই ভেসে যাই’ বইটি প্রকাশ করেছে জাগত🅷িক প্রকাশন। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইটির মূল্য ৩৫০ টাকা। প্রকাশকাল ২০২২।