১.
মান-অভিমানে একজন রান্না চালিয়ে গেলেও, খাওয়া বন্ধ করত প্রায়ই। ভাত-তরকারি সাজিয়ে রাতে ছাদে গিয়ে বসে থাকত। দিনে যদি গাল ফুলত, তো তাকে পাওয়া যেত চিলেকোঠায়।
অন্যজন কি নেয়ে-খেয়ে ঘুমিয়ে যেত, তা তো নয়!
যত যা-ই হোক, ভাত সে একলা মুখে তুলত না। সোজা কথায় না এলে জাপটে ধরে কোলে করে ঘরে আনত। বলত, ‘তুমি জানো না, আমি একলা ভাত খেতে পারি না!’
বেশ চলছিল, কিন্তু তাদের। টক-ঝাল-মিষ্টি আচারের মতো।
আচার যেমন চেখে খেতে খেতে ফুরিয়ে যায়। সে বা তারাও ফুরিয়ে গেল। সবাই যদিও বলল—পাড়ার সেরা সুন্দরী বউটির এইভাবে মৃত্যু তারা কল্পনাও করতে পারে না।
কীভাবে? কলতলায় পিছলে পড়েছিল শুধু। কাটা-ছেঁড়া কিচ্ছু নয়। কেবল চোখটাই আর খুলল না।
অন্যজন? সে আছে। সে তো একা থাকতে জানে না। তাই সে মাস ꦬনা যেতেই দোকা খুঁজে নিয়েছে।
তাদের আর মান-অভিমান হয় কি না, আমি জানতেও চাই না।
২.
পরপর তিন-চার দিন স্বপন কাকার পেছনে ঘুরেও একটা চিঠি আনতে পারলাম না। কনকনে ঠান্ডার ভেতর আব্বা গলায় মাফলার জড়িয়ে হাফ সোয়েটারের ওপর শার্ট আর চাদর পরে বেরিয়ে গেলেন ভোর ভোর। দুই পা যেতেই কুয়াশার ভেতর ঢুকে গেলেন আব্বা।
স্বপন কাকা বলত—চিঠি আসেনি।
—আসেনি কেন? আব্বা যে বলল, পৌঁছেই একটা চিঠি লিখে দেবে!
—আচ্ছা। হয়তো আসছে। পথেও তো দেরি হয়, নাকি!
থুতনি আর গলা একসঙ্গে করে ফিরে আসতাম। মা উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকতেন। কিছু বলতেন না।
আজও কি মা ভাত খাওয়ার সময় বারবার পানি খেয়ে উঠে যাবেন!
‘তোর আব্বার একটা খবর না পেলে ভাত আমার গলা দিয়ে নামবে না— মায়ের এই এক কথা প্রতিবার। কেন? আমাদেরও আব্বার জন্য চিন্তা হয়। কিন্তু ভাত না খেয়ে থাকতে পারি না যে!
সাত দিন শেষেও চিঠি এলো না। স্বপন কাকা চিঠি নিয়ে এসে হাঁক দিলেই আমরা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলি। কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসে। আমাদের ফাটা ঠোঁটে হাসি আঁকা যায় না।
তবু আমরা রাস্তায় বের হই। আব্বার অফিসের নম্বরে টেলিফোন করতে। প্রথমবার তোশকের তল থেকে টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটা বের করেন মা।
বড় আব্বার বাড়ির সদর দরজায় ভয়ে ভয়ে টোকা দিই। গলা খুব নরম করে কান্নাগুলো ঢাকাচাপা দিয়ে—আব্বার অফিসে একটা ফোন করা যাবে? আব্বা যাওয়ার পর কোনো খবর আসেনি।
বড় আব্বার উঁচু বাড়ির মতো সবার গলাও খুব উঁচু ‘ও তোর আব্বা তো দিন দশেক আগে একবার ফোন করেছিল।’
‘আব্বার ফোন? কই জানি না তো! ভালো আছে তো আব্বা?’
‘কেমন আছে, তা তো আমি বলতে পারব না। সে বলল যে ভালোভাবেই পৌঁছে গ❀েছে♊। অফিসে কাজের খুব চাপ। সময় করে চিঠি লিখবে।’
আমরা দৌড়ে বাড়িতে আসি
‘মা...মা তুমি ভাত খাও ভালো করে। এবার তো আব্বার খবর টেলিফোনের তার বেয়ে এসেছে!’
মা আজও ভাতের পাতে বসলেন না। হয়তো আব্বা কী খাচ্ছেন, কেমন আছেন; এই জিজ্ঞাসার দোꦑলাচাল ঘোর আব্বার মুখ না দেখা পর্যন্ত তার কাটবে না!
৩.
পেট ভরা ক্ষুধা নিয়ে মসুর ডালে পুঁই শাক আর আলু-ডিমের তরকারি করলাম। তিনটা মুরগির ডিম আর পাঁচটা আলু দিয়ে।
অসহ্য গরম পড়ছে কদিন হলো। ঘাম মুছে মুছে শাড়ির আঁচল পচে যাচ্ছে৷ সঙ্গে খুসখুস কাশি।
রান্না শেষ করতে করতেই হাত-পা অবশ হয়ে এলো। আমি রান্নাঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলাম। না, আসলে শুয়ে পড়লাম। তৃষ্ণায় আমার কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। কেউ যেন আটকে দিল চারপাশের বাতাস। একটু যদি বুকটা ভরে নিশ্বাস নিতে পারতাম!
পান্তু দৌড়ে এলো। আমি যদিও ডাকিনি, তবু ও এলো। হয়তো কোনো আবদার নিয়ে! আমাকে ওভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে চুপ থেকে তারপর হাউমাউ কান্না জুড়ে দিল।
আহা! বাচ্চাটা আমার! কিছু বলা হলো না তোকে!
আমার খুব খারাপ লাগল, এভাবে হঠাৎ চলে আসার জন্য। নিজেকে এত অপরাধী লাগছে।
পান্তুর আব্বাকে খুব কষ্ট করতে হলো দরজা খোলার জন্য। আ🌟র পান্তুর কান্না! আমার বুকহীন হৃদয়টꩲা ফেটে গেল! অথচ দরজা খোলার পর পান্তুর আব্বা দেখল, আমি শুয়ে আছি। আমার কি শুয়ে থাকা মানায়? দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার ক্ষুধাও মরে গেছে। কিন্তু পান্তু! ওর যে অনেক্ক্ষণ খাওয়া হয়নি!
পান্তুর আব্বা যদিও বরাবরই বুদ্ধিমান। আমাকে একবার দেখেই বুঝে গেল সব। ভেবেছিলাম, হাতটা একবার ধরে দেখবে। কিন্তু সে যে বুদ্ধিমান! দেখার আগেই বুঝে যায় সব!
পান্তুকে দুই-তিনবার ডাকল। পান্তু আমাকে ছেড়ে নড়ল না।
এখন লোকজন ডেকে জড়ো করা মানে নিজেরই বিপদ বাড়ানো। বুঝি। এসব আমিও বুঝি।
পান্তুর আব্বা ধীরেসুস্থে হাত-মুখ ধুয়ে আমার কেচে রাখা পরিষ্কার তোয়ালেতে মুখ মুছল। তারপর পান্তুকে ডেকে নিল। পান্তুকে ভালো করে সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করাল। আমি সত্যি অবাক হলাম। পান্তুর আব্বা প্রথমবার পান্তুর জন্য এসব করছে।
পরিষ্কার জামাকাপড় পরে পান্তু ওর বাবার হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো। পান্তু যদিও ঘাড় বাঁকা করে বারবার রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা আমার দিকে তাকাচ্ছে। পান্তুর বাবা টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার দেখল ঢাকনা তুলে। পান্তুর আমার কাছে আসার জন্য ঘসটে চেয়ার থেকে নামছে।
ইশ! যদি পারতাম আমার এই পরিত্যক্ত দেহটা নিয়েই আমি বিদায় হতাম।
পান্তুর আব্বা সত্যিই বুদ্ধিমান! ছেলেকে মোলায়েম ম্যানেজ করে নিল।
‘তোমার আম্মাকে এখন ডাকলে, আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে। একটু ঘুমাতে দাও। তারপর তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যখন উঠবে, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
আহ! আমার পান্তু যেন এভাবেই সব ভুলে থাকে!
আমি গোটা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখি। রান্নাঘরের মেঝে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। সবকিছুই আগের মতো।
কেবল আজ তরকারির বাটিতে একজনের খাবার অহেতুক পড়ে আছে। পচে যাবে নিতান্ত গুরুত্বহীনতায়; যেমন আমার প♔্রেম!
নিরুদ্দেশের পথিক হওয়ার আগে অনন্ত জেনে গেলাম, খ🌊াবার ও প্রেম সমার্থ। উভয়ই পচনশীল!