মেলার মৌসুমে রিকশাওয়ালাদের ভাগ্য ফেরে। শীতের আমেজকে জিইয়ে রেখে সপ্তাহব্যাপী লক্ষ্মীপুরের মেলা বসে। রাজধানী ঢাকা থেকে আসে হাজার হাজার ভক্ত। ভিড় জমায় মোহনবাগ লঞ্চঘাটে। তখন রিকশাওয়ালাদের চোখে-মুখে জেল্লা ধরে। কায়দা করে যাত্রীদের কাছে ভাড়া হাঁকে তিন গুণ। মৌসুম শেষ হলে প্রায় সারা বছর নসু চাচার চায়ের দোকানে আড্ডা জমায়। গল্প করে, চা খায়। আবার কখনোবা সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে আকাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকে। সাগর একা নয়। অন্য রিকশাওয়ালারাও। এমনিভাবে কর্মহীন অলস দিন কাটে আবার রাত আসে। একে তো গ্রামের কাঁচা বেঢপ রাস্তা। খ্যাপ বেশি পাওয়া যায় না। সারা দিনে বড়জোর পাঁচটা। খুচরা খ্যাপও মেলে। ঢাকার যাত্রী হলে মোহনবাগ লঞ্চঘাট আর থানা সদরের যাত্রী হলে উজিরপুর। দূরের পথ এ দুটোই। মুখচেনা কিংবা অতিচেনা কেউ হলে বিশ টাকার জায়গায় পনেরো টাকা দিয়ে নেমে পড়ে। শত চেঁচামেচিতেও কোনো ফল হয় না। তারপরও সাগররা থেমে থাকে না। পাঁচ-দশ টাকা বেশি আয় করার চেষ্টা-তকলিফ চালায়।
বাসন্তীপুর বাজারসংলগ্ন খালের ওপর ওয়াপদা বেড়ি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের ওপর গড়ে উঠেছে রিকশাস্ট্যান্ড। খ্যাপ না মিললে বেশির ভাগ সময় স্ট্যান্ডেই থাকে সাগর। স্ট্যান্ডের পাশেই বড় বটগাছটির নিচে নসু মিয়ার চায়ের দোকান, যাকে ওরা নসু চাচা বলেই ডাকে। ছমির, তোতা, ফালু, মোংলা এবং সাগর—এরাই বেশির ভাগ সময় এখানে বসে। কেবল সাগর ছাড়া অন্যদের রিকশা চালানো একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। জেলা বোর্ডের রাস্তা হওয়াতক এরা এ পথে। দু-একজনের শহরে রিকশা চালানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও আছে। সাগর এ পথকে নতুন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে অনেকটা নিরুপায় হয়ে। সাগর যখন একা থাকে, তখন স্কুলজীবনের সব স্মৃতি, পুরো পলাশতলি গ্রাম, গ্রামের ছায়াঢাকা পথ, নির্জন পথে একাকী হেঁটে হেঁটে আনমনে সিনেমার গানের কলি আওড়ানো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পদ্মা নদী থেকে সুদূর ইছামতিতে এসে যে শাখা নদীটি পড়েছে, তার দুই ধারে গড়ে উঠেছিল পলাশতলি গ্রাম। পাঁচ শ ঘর গৃহস্থ ছিল এই গ্রামে। মেম্বার বাতেন খাঁ এবং মনির মাস্টারের উদ্যোগে গ্রামের মাঝাবরাবর গড়ে উঠেছিল প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের ঠিক আধা মাইল উত্তরে ছিল সাগরদের বাড়ি। ওরা তখন একান্নবর্তী পরিবারে বাস করত। সাগররা ছিল মোটা গৃহস্থ। ও তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ওই বছরই পদ্মার ভাঙন শুরু হলো। প্রাইমারি স্কুলসহ প্রায় তিন শ ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হলো। আশ্রয়হীন বেশির ভাগ গৃহস্থই পদ্মার অপর পারে (ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানা) আশ্রয় নিল। তা সত্ত্বেও প্রাইমারি স্কুলটা গ্রামের উত্তর প্রান্তে বাতেন খাঁর আবাদি জমির ওপর উঠানো হলো। ইছামতি নদীর তীরে জামতলী গ্রামে দশ কাঠা জমি কিনে নতুন বাড়ি করল সাগররা। ওর বাবা আবিদ খন্দকার হালের বলদ বিক্রি করে বিভিন্ন হাটে রকমারি ডালের ব্যবসা আরম্ভ করল। এভাবে মাঝারি হালে কেটে যাচ্ছিল সাগরদের দিন। সাগর যখন বাসন্তীপুর হাইস্কুলের নমব শ্রেণির ছাত্র, তখন এক শীতসকালে ঠিক সূর্য ওঠার আগে ওর বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। টাইফয়েড রোগে দীর্ঘদিন ভোগার পর সূর্য মাথার ওপর হেলান দেওয়ার সময় নিজেও হেলে পড়লেন। ফলে সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল স্কুলবালক সাগরের কাঁধে। মা জরিনা বেগম, দুই বোন এবং ছোট ভাইকে নিয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগল সাগর। কেবল বাড়িটুকুন ছাড়া অন্য সব জমি জিরেতও পদ্মাগর্ভে। এই ভয়ানক দুরবস্থার মধ্যে মুষড়ে পড়েছিল সাগর। মনির মাস্টার ওকে খুব স্নেহ করত। এই বিপদে সে-ও এসে পাশে দাঁড়াল এবং কেবল দাঁড়িয়েই রইল। সাগরদের সংসারের পেলা (সাহায্যকারী খুঁটি) হতে পারল না। শেষে পড়ালেখা ইস্তফা দিয়ে বাবার ব্যবসা শুরু করল। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সাগর খুব সুবিধা করতে পারল না। বছর অতিবাহিত হতে না হতেই চালানপাতি সব লাটে উঠল। নিজে নিজে পড়ালেখা করে এসএসসি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল। শেষতক তা-ও সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না। সংসার চালানোর চিন্তাটা হামানদিস্তার মতো ওকে বিরামহীনভাবে পেটাতে লাগল। দুমুঠো ভাতের জন্য, এক টুকরো রুটির জন্য সারা গ্রাম ওর ভাইবোন ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াবে, তা ওর সহ্য হবে না। ওর বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়—আস্তে আস্তে পাহাড় জমতে থাকে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে সাগরের মনে হলো সে অচিরেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে। এবং সে এতটাই অপ্রিয় যে কেউ তাকে দাফন করতে আসবে না কিংবা শেয়াল, কুকুর, শকুন কেউই তার মরা মাংস স্পর্শ করবে না। তার লাশে পচন ধরবে এবং পুরে এলাকার বাতাসকে দূষিত করবে। আর ওই দূষিত বায়ু সেবন করে এলাকাবাসী কিশোর সাগরকে অভিসম্পাত দেবে। দিতেই থাকবে। আর তার বুভুক্ষু মা-ভাই-বোনেরা খেতে না পেয়ে বীভৎসভাবে পৈশাচিক হাসি হাসবে। এবং হেসে হেসে জীবনপাত করবে। নিজেকে নিয়ে যখন সাগর এত সব উদ্ভট ও ভবিষ্যৎ ভাবনায় বিভোর, ঠিক তার পরের দিন বাড়ন্ত বেলায় মা-ভাই-বোনদের মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশায় ওঠে সাগর।
ছোট্টবেলার টকটকে বিকেলগুলোর কথা ফসলের সবুজ মাঠে স্থানীয় বাতাসের হামাগুড়ি দেওয়ার দৃশ্যের কথা, দূর আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে মাঠের মধ্যে লাটাই ধরে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকার কথা কিংবা বাবার সঙ্গে পদ্মায় মাছ (ঝাঁকি জালে) ধরার কথা কুয়াশা কুয়াশা মনে পড়ে ওর। কত না আনন্দঘন দিন ছিল সাগরের। ওই সব কথা ওকে খোঁচায়, জ্বালায়। ওর মাথাা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। যেন একটা অবিনাশী ঘুণপোকা ওর মাথার সব মগজ কুটুস কুটুস করে কেটে খাচ্ছে এবং অনবরত খেতেই থাকবে নিঃশেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। মনের ভেতর সব দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট চাপা দিয়ে রেখেছে সাগর। কারণ, এসব প্রকাশ করে কোনো লাভ নেই। তাতে হাহাকার আর দীর্ঘ নিশ্বাসের পাল্লাটাই কেবল ভারী হবে।
রিকশা চালাতে চালাতে হাঁপসে ওঠে সাগর। শিরদাঁড়া বেয়ে দর দর করে ঘাম নেমে আসে। তার পরও ওর বিরাম নেই। ওর সহপাঠীরা অনেকেই আজ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিকশাসহ সাগরকে দাঁড়ানো দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠে। অনেক পরিচিতজনকে দেখা যায় মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে। সাগরের অবস্থা পরিমাপ করে সবাই বিস্মিত হয়। একি অবস্থা সাগরের। পরনে একটা ময়লা লুঙ্গি, গায়ের গেঞ্জিটা ছেঁড়া এবং আরও অধিক ময়লাযুক্ত। মাথায় গামছা বাঁধা এবং কালো শীর্ণ দেহ। উচ্চতায়ও সাগর খাটো। এই ভয়ানক নোংরা গোছের ছেলেটিকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দোষের কিছু নয়। তারপরে সাগর খ্যাপের আশায় জেলা বোর্ডের রাস্তায় দাঁড়ানো। কোনো খুচরো খ্যাপ নয়, দূর পথের খ্যাপ। সাগরের চোখ-মুখ যেন ভয়ানক অসহায়তায় থির থির করে কাঁপছে।
সাগরকে নিয়ে কথা ওঠে গ্রামে, কথা ওঠে চায়ের আড্ডায়, ফসলের মাঠে। কথা উঠতেই থাকে। সাগর রিকশা চালায়। তা-ও আবার নিজ এলাকায়। রিকশা যখন চালাতেই হবে তখন লোকলজ্জার ভয়ে লুকুছাপার কি আছে, মনে মনে এই ধারণা পোষণ করে সাগর। কখনো কখনো এসব কথা শুনে আহত হয় ও। নিজ এলাকা এবং ভিন্ন এলাকায় রিকশা চালানোর মধ্যে কোনো ব্যবধান খুঁজে পায় না সাগর। বরং নিজ এলাকায় রিকশা চালাতে ও বেশি আনন্দবোধ করে। প্রতিদিন কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয় ওর। চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরপরিচিত ঘনিষ্ঠ কারও মুখশ্রী। মানুষের নানা কথা শোনার পরও আগের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সাগর। যেন ওই জগতের সে একজন বাসিন্দা। বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা মারে সাগর। ‘সব কপালের ফের। কোথায় লেখাপড়া শিখে মানুষ হব, তা না হয়ে রিকশা চালিয়ে “তামাম ঘর গোষ্ঠীর” খোরপোশ জোগাতে হয়।’
ইদানীং নানাজনে নানা ধরনের বিদ্রূপ করে ওকে। কখনো কখনো কোনো পরিচিত যাত্রী রিকশায় জেঁকে বসে কর্মসংস্থানের ভিন্ন পথ বাতলে দেয়। কথাগুলো সাগরের শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে আসে। বুকের কোণে জমে থাকা ব্যথাটা আরও তীব্র অনুভব করে সাগর। ঘালের কাছে মশা রক্ত খায় চটাশ শব্দে মশা মারে সাগর। মাতবর বড়ির বেওয়ারিশ কুকুরটা একনাগাড়ে ঘণ্টাখানেক ঘেউ ঘেউ ঘ্যার ঘ্যার করে এইমাত্র থেমে গেল। অন্ধকার ভেদ করে দু-একটা খুচরো শব্দ ভেসে আসে। ঘরের কোণে আরশোলা, ইঁদুর-ছুঁচোর চলাচলের সর সর শব্দ শোনা যায়। ঘুম আসতে চায় না ওর। গরমে হাঁসফাঁস করে ও। মনে পড়ে স্কুলজীবনের কথা, মনির স্যারের কথা, যমুনার কথা। তখন মনে রঙিন স্বপ্ন ছিল। সব শ্রেণিতেই প্রথম হতো সাগর। দ্বিতীয় যমুনা। যমুনা তখন ওর কত ঘনিষ্ঠ ছিল। যমুনাদের বাড়িতে কোনো ভালো খাবার তৈরি হলে সাগরকে ছাড়া খেত না যমুনা। অথচ কাল বিকেলে ভিন্ন এক যমুনাকে মোহনবাগ লঞ্চঘাট থেকে ওরই রিকশায় নিয়ে এলো সাগর। যমুনা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। জননেত্রী যমুনা খন্দকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যমুনার নামটা সবার মুখে মুখে। আর সাগর। কথাটা ভাবতেই ওর মাথাটা ঘূর্ণির মতো মোচড় দেয়। ওর শীর্ণ-তোবড়ানো মুখ ক্রমেই বীভৎস হয়ে ওঠে। ওর এই দুরবস্থার কথা ভেবে সামান্য করুণাই কি কেবল সাগরের প্রাপ্য ছিল। অন্য কোনো কথা। যমুনা সাগরকে যা জিজ্ঞেস করেছিল, তার সঠিক উত্তরও সাগর দিতে পারেনি। ওর ঠোঁট জোড়া যেন গাড়ির টায়ারের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। যমুনাকে ভালো করে দেখে নিয়েছিল সাগর। বেশ সুন্দর আর আঁটসাঁট শরীর হয়েছে ওর। ওর মনে হয়েছিল যমুনা ঠিক আগের মতো ওকে অনেকটা জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে বাড়িতে। ঠিক আগের মতো ওর চঞ্চল কোমল হাত স্পর্শ করবে ওর মরাল গ্রীবা, ঠোঁট-নাক। চুলে বুলিয়ে দেবে হাত। কত বছর পর আবার কাছাকাছি পেল যমুনাকে। ওর মনে হলো যমুনার শরীরের সেই মাদকতা মেশানো ঘ্রাণ আর নেই, যে ঘ্রাণের কারণে সময়ে-অসময়ে ছুটে যেত যমুনার কাছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে যমুনার শরীরী ঘ্রাণটা পরিপুষ্ট হয়ে এখন যা ছড়াচ্ছে, তা সেই ঘ্রাণ নয়। সাগরের মনে হলো ঘ্রাণটি সম্পূর্ণ অপরিচিত। যমুনা যেন সাগরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে। আর তার উত্তর দিতে গিয়ে সাগর অপরাধীর মতো আমতা আমতা প্রকাশ করছে। যেন যমুনার হাত থেকে পালাতে পারলে সে বাঁচে। অথচ একদিন সে যমুনাকে কেন্দ্র করে নানা ভাবনা ভেবেছিল। তাই দশ বছর আগের যমুনাকে কেন্দ্র করে যে গন্ধ অনুভব করত সাগর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তা যেন ঝিমিয়ে গিয়েছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তাই তো ওর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। সাগর অনুমান করতে পারল রাত ভোর হতে চলেছে। পাশে ছোট ভাই জাহাঙ্গীর ল্যাদা মেরে পড়ে ঘুমের ঘোরে ঘোঁত ঘোঁত শব্দে নাক ডাকছে। কিন্তু ও যেন ভারী কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে থেঁতলে গিয়েছে। প্রচণ্ড অস্থিরতায় সিপ সিপ করে কাঁপছে। মসজিদ থেকে করিম মুসল্লির আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। চালের ওপর আলতো ঢিল পড়ার শব্দ ওঠে। শব্দ ওঠে চারদিক থেকে। ঘরের পেছনে গাছের শুকনো ভারহীন পাতা খসে পড়ার শব্দ ওঠে। ক্রমেই চারদিক শব্দের জগৎ মুখরিত হয়ে ওঠে।
সকাল বেলা ফালুটা এসে বেশুমার ডাকাডাকি আরম্ভ করে—ওই সাগর। উডছনা, জলদি উড। মনে নাই আইজকা আডের দিন। সকাল সকাল গাড়ি বাইর করতে অইবো। ফালুর ডাক শুনে প্রথমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সাগর। তারপর ধড়মড় করে উঠতে চেষ্টা করল। ওর পাঁজর জির জির করে উঠল। দাঁতগুলো কড়মড় করতে লাগল। ওর মনে হলো হৃৎপিণ্ডের বোঁটা ধরে কে যেন হঠাৎ হ্যাঁচকা টান দিল। অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো সাগর। প্রথমে ফালুকে উদ্দেশ করে বিশ্রী গোটা চারেক বকা দিল, তারপর চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে গামছাটা কাঁধে ফেলে ফালুর সঙ্গে গ্যারেজের দিকে পা বাড়াল। পায়ের বেগ যেন কিছুতেই বাড়তে চাচ্ছে না। চারধারে এক ধরনের কদর্য হিল্লোল নেমে এলো। আস্তে আস্তে সাগরের মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠল। ওর কর্মজীবনের সমস্ত ব্যথা ও একজনকে জানাতে চেয়েছিল কিন্তু সে সময় এবং সুযোগ অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছে। দুজনে অস্পষ্ট কথাবার্তা চালায়। আকাশের দিকে তাকায় সাগর। ওর মনে হলো ভোরের আকাশের গায়ে আজ ধ্যাবড়া ভ্যাবড়া করে বাড়তি রং লাগানো হয়েছে। আর সে রঙের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা আছে কতগুলো কথা—যে কথা দীর্ঘদিনের সঞ্চিত এবং যা যমুনাকে সে বলতে চেয়েছিল। ঠিক এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের পোস্ট মাস্টার গল্পের নায়কের মতো এক দার্শনিক ভাবের উদয় হলো—সত্যিই জীবনটা পাকে পাকে বাঁধা। মানুষ পাল্টায়। মানুষের মনও পাল্টায়।’ প্রচণ্ড রোদেলা দুপুর। চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ। কোথাও বাতাসের লেশমাত্র নেই। সাগার খ্যাপ নিয়ে চলছে উজিরপুরের দিকে। রোদে ওর কটা চোখ দুটো মিইয়ে আসছে। শিরদাঁড়া বেয়ে দর দর করে ঘাম নিচে নেমে আসছে। মাথার গামছা খুলে মাঝে মাঝে ঘামে ভেজা শরীর মুছে নেয় সাগর। ঘামে ভেজা গেঞ্জি থেকে একধরনের ভ্যাপসা গন্ধ এসে মাঝে মাঝে ওর নাকে লাগে। অথচ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। খ্যাপ নামিয়ে দিয়ে বিশ টাকা পকেটে পুরে। এতক্ষণের দারুণ ক্ষুধা অনুভব করে ও। হালকা ধরনের কিছু একটা খাবারের জন্য একটা আধা-ভাঙা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। যার আদল ঠিক ওর এই মুহূর্তের শরীরের মতো। জীবনের কঠোর বাস্তবতাকে এ সময়ে উপলব্ধি করে সাগর।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। অকারণে ওর মেজাজ খিঁচড়ে যায়। ও একাকী নিজের সঙ্গে গুজুর গুজুর করতে থাকে। উজিরপুর হাটের বারোয়ারি কোলাহল ভাটা পড়ে আসে। খ্যাপ নিয়ে বাসন্তীপুরের দিকে ফিরে সাগর। খ্যাপ নামিয়ে নিয়ে নসু চাচার চায়ের দোকানে বসে। বড় করে হাঁক ছাড়ে চাচার উদ্দেশে। তারপর সে পরপর দুই গ্লাস পানি ঢকাস ঢকাস গিলে। তবু গলাটা শুকিয়ে আসে সাগরের। যেন মরুভূমির তৃষ্ণা তার পেটে। খসখসে গলায় ফালুকে ডাকার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখ দিয়ে কেবল বাতাসের একটানা হিসহিসানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। ঝড়– উত্তেজনায় তোতলাতে থাকে। খ্যাপ নামিয়ে দিয়ে গেল কোথায় ফালুটা? ফালুকে উদ্দেশ করে মনে মনে আবারও একটা বিশ্রী গালি দেয়। অবশেষে হাত-পা কচলাতে কচলাতে পূর্ণ শরীর নিয়ে পা ফেলে হন হন করে বাড়ির দিকে ছুটে। এই অবস্থায় প্রথমে ওর কপালে গোটা চারেক ভাঁজ পড়ে এবং কপালের দুই পাশের রগগুলো অনবরত লাফাতে শুরু করে দেয়। পেটের ভেতর ক্ষুধা বেড়ালের নখের মতো আঁচড় কাটে। ওর চওড়া এবং রেখাহীন কপালে নোনতা ঘাম জমে। একটু দাঁড়ায় আবার লম্বা দম নিয়ে হাঁটতে থাকে ও। যেন অন্ধ একটি শক্তি ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো বলদের মতো চোখ জোড়াকে হাবা বানিয়ে চারদিকে অর্থহীনভাবে তাকায়। অনেকটি নিজের অজান্তে হো হো হাসে। আকাশের রং দ্রুত বদলাতে শুরু করে। পৃথিবীতে বিবর্ণ আলো ছড়িয়ে পড়ে। সাগরের মনটা বিষণ্নতায় কুঁচকে যায়। বাড়িতে ঢুকে মাকে ভাত বাড়তে বলে। তারপর আমতলার দিকে দৃষ্টি মেলে। আমতলায় একমাত্র গাভিটি ঝিমুচ্ছে আর ফোঁস ফোঁস করে দম নিচ্ছে। চকিত পায়ে আগুয়ান একটি ধ্যাবড়া গোছের লাল মোরগ গাভিটির কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। গাছের দু-একটি শুকনো পাতা খসে পড়ে ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে। গাছের মগডাল থেকে হঠাৎ একটি পাখি কঁকিয়ে উঠল। মাটির শানকিতে ফ্যান-কুড়া গুলিয়ে গাভিটির সামনে ধরে সাগর। সস্নেহে কতক্ষণ হাত বুলায় গাভিটির শরীরে। তারপর সারা দিনের জিয়ানো অবসন্নতা নিয়ে ধপাস শব্দে আমগাছটির নিচে বসে পড়ে। মা জরিনা খাতুন ভাত বেড়ে বাইরে এসে সাগরকে ডাকে। সাগরের ক্লান্ত চোখ দুটো সেঁটে থাকে মায়ের দিকে। বাইরের আলো আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে ক্রমান্বয়ে গাঢ় হতে আরম্ভ করে। সাগর খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়।
দিন সাতেক অতিবাহিত হলো যমুনা গ্রামের বাড়িতে এসেছে। এই সাত দিনের মধ্যে অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে যমুনাকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। নিজেকে সামাল দিতে না পেরে একদিন যমুনাদের বাড়ির কাছাকাছি অনেকক্ষণ ঘুর ঘুর করেছিল সাগর। তারপর সাতপাঁচ ভেবে দুর্বল মন নিয়ে ফিরে এসেছে।
সাগরের মনে হলো যমুনাকে তার অনেক কিছু বলার আছে এবং সেই কথাগুলো না বলা পর্যন্ত ও স্বস্তি পাবে না। কিন্তু যমুনার কি সাগরের কথা শোনার সময় আদৌ আছে। অথবা সে গুরুত্ব দিয়ে কি সাগরের কথা শুনবে? মনের ক্ষোভমিশ্রিত দুঃখকে আড়াল করার জন্য সাগর নসু চাচার চায়ের দোকানে গল্প জুড়ে দেয়। কখনোবা আয়েশ করে চা খায়। চা খেতে খেতে যমুনার হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখ তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামনে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে সাগর। সাগর দেখতে পায় যমুনা ঠিক আগের কিশোরী যমুনাই আছে। সাগর আর যমুনা দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। আকাশের দিকে নেকনজরে তাকায় সাগর- আকাশেরও একই রকম দৃশ্য। ফালুর ডাকে সংবিত ফিরে পায় সাগর। সে যে এতক্ষণ নিজের রিকশায় বসে এত সব ভাবছিল, তা বুঝতে পারে ফালুর সঙ্গে কথা বলার পর। ফালুর ডাকে তার সুখচিন্তার ফানুস ভাঙলেও কিছুই বলে না ফালুকে। দুজনে নসু চাচার দোকানে পুনর্বার বসে। চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে শহর থেকে আসা গতদিনের পুরোনো দৈনিক কাগজ হাতে নেয়। চটকদার খবর জোরে জোরে পড়ে ফালুসহ অন্যান্য রিকশাওয়ালাকে শোনায়। কখনো গুরুত্ব বুঝে নিজের প্রয়োজনে পড়ে—দেশের রাজনীতির খবর, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর, সড়ক দুর্ঘটনার খবর, নারী ধর্ষণ ও অপহরণের খবর, দুর্নীতি-জালিয়াতির খবর, খুন-হত্যা ও অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর। কখনো বা পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে। থুক করে পানের পিক ফেলে মাটিতে। কানের কাছ থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। কখনো বা বড় ধরনের একটি শ্বাস নিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে ভেতরে ভেতরে পরম তৃপ্তি অনুভব করে।
যমুনার ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে ফজরের ওয়াক্তে রিকশা নিয়ে বের হয় সাগর। রিকশাস্ট্যান্ডে এসে যমুনার অপেক্ষায় থাকে। যমুনা যখন রাজধানী শহরে যাওয়ার জন্য রিকশাস্ট্যান্ডে আসবে, তখন যে করেই হোক সাগর তাকে তার রিকশায় তুলে নেবে এবং গতবারের মতো যমুনার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ওর কাছ থেকে কোনো ভাড়া নেবে না। তারপর রিকশা চালাতে চালাতে সুযোগ বুঝে যমুনাকে তার মনের মধ্যে আজন্ম লালিত কথাটা বলবে। কথাটা প্রথমে কোথা থেকে শুরু করবে মনে মনে বার কয়েক তার রিহার্সাল দেয় সাগর। সাগর আজ বেশ পরিপাটি পোশাকে এসেছে। মাথার চুলগুলোও বিন্যস্ত করেছে অন্যভাবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। স্ট্যান্ডের অন্য রিকশাওয়ালারা খ্যাপ মারার কাজে ব্যস্ত অথচ সাগরের সেদিকে মনোযোগ নেই। সাগর স্ট্যান্ডে বসে ঝিমোচ্ছে তো ঝিমোচ্ছেই। আস্তে আস্তে দুপুরও গড়াতে থাকে, তবু সাগর খ্যাপের ধান্ধা করে না। ঘাপটি মেরে স্ট্যান্ডেই থাকে। এমনকি দুপুরের খাবারের কথাও সে বেমালুম ভুলে যায়। সূর্য ডোবে। গাঢ় হয়ে অন্ধকার নামে। একটি চাপা দুঃখকে জিইয়ে রেখে অবসন্ন মনে বাড়িতে ফেরে। সারা দিনের নেতিয়ে পড়া অপেক্ষার শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুমের পরিবর্তে বুক ফেটে কান্না আসতে চায় ওর। গলাটা হাঁসের মতো তড়পাতে থাকে। দীর্ঘ চেষ্টার পর একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে সাগর। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে যমুনাকে স্বপ্ন দেখে। তারই রিকশায় যমুনা লঞ্চঘাটে যাচ্ছে। সাগরের আজ সবচেয়ে আনন্দের দিন। তার আজন্ম লালিত কথাটি বলার জন্য রিকশায় প্যাডেল মারতে মারতে যমুনার দিকে তাকায়, শেষ পর্যন্ত যমুনাকে তার না বলা কথাগুলো আর বলা হয়ে ওঠে না। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে সারা শরীর অবশ হতে আরম্ভ করে এবং ফজরের নামাজের ঠিক আগে ঘুমের ঘোরে একধরনের গোঁ গোঁ শব্দ করে জেগে ওঠে। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। কেবল সারা শরীর কাঁপতে থাকে। পরে আস্তে আস্তে পুরো ঘটনা ওর আয়ত্তে আসে।
ভোর ওয়াক্তে ফোলা ফোলা চোখ আর তিক্ত মেজাজ নিয়ে রিকশা চালাতে বের হয়। মাঝপথে গিয়ে জানতে পারে যমুনা একটু আগে ফালুর রিকশায় ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে। সাগর খালি রিকশা ছোটায় লঞ্চঘাটের দিকে। শরীরের সব শক্তি পায়ে এনে দ্রুত প্যাডেল মারতে থাকে। উদ্দেশ্য যমুনাকে কেবল একনজর দেখা। বৃষ্টিতে ভিজে হাঁপাতে হাঁপাতে লঞ্চঘাট পৌঁছে সাগর। ততক্ষণে লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঘাম এবং বৃষ্টিভেজা শরীর থেকে একধরনের বিশ্রী গন্ধ বাতাসে ছড়াতে থাকে। মাঝে মাঝে ওর নাকে এসেও লাগে। কিন্তু সেদিকে লক্ষ নেই ওর। ও গভীর মনোযোগ দিয়ে লঞ্চটি অদৃশ্য হওয়া দেখে। চোখ দুটো ওর ছল ছল করে ওঠে। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করে। চোখের দৃষ্টি আস্তে আস্তে হালকা ঝাপসা থেকে গভীর ঝাপসায় পরিণত হয়। এই অবস্থায় চারদিক কী যেন পরখ করতে চেষ্টা করে ও। এই মুহূর্তে ফালুকে ওর ভীষণ দরকার। যমুনা ফালুকে ওর কথা কি কিছু জিজ্ঞেস করেছে? এই কৌতূহল মিশ্রিত প্রশ্নটি ওর কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। পুরো পলাশতলি গ্রাম, প্রাইমারি স্কুল, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, মনির স্যার, পদ্মার ভাঙন ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ও আপন মনে বিড় বিড় করতে থাকে। বাইরে কোথাও গাছের ꧅মগডালে কাক ঝিমোয়। দূরে কোথাও বেদনার্ত কণ্ঠে কান্না ভেসে আসে। ওর দৃষ্টি আরও ঝাপসা এবং খাটো হতে শুরু করে। অকারণে চুপসানো গলায় ফ্যাসফ্যাস শব্দ করতে থাকে সাগর। সারা লঞ্চঘাট খুঁজেও ফালুকে পাওয়া যায় না। খালি রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে সাগর। ঢাকা🦩গামী লঞ্চের একধরনের শোঁ শোঁ ভোঁ ভোঁ করুণ শব্দ তার কানে বেজে ওঠে। সেই শব্দের মধ্যে অন্য কোনো মাদকতা ছিল কি না, তা সাগর বলতে পারবে না।