মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ হিসেবে ২০২১ সালে ইতিহাসের উদ্যাপন অনেকভাবে ঘটবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। তবে এই উদ্যাপন যেন আড়ম্বর-প্রধান হয়ে না পড়ে, তেমন শঙ্কাও আমাদের রয়েছে। বিশ শতকের ইতিহাসে বিশাল অভিঘাত-সৃষ্টিকারী ঘটনা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব। সে জন্য জাতিকে দিতে হয়েছে বিপুল মূল্য, পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর আঘাতের বাইরে ছিল না কোনো লোকালয়। রক্তস্রোত বয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি জনপদে, প্রতিরোধের স্পৃহাও সঞ্চারিত হয়েছিল সর্বত্র। সেই ইতিহাস নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করবার রয়েছে, ইতিহাস-উদ্ধারে অনেক কাজ হয়েছে বটে, তবে এখনো উদঘাটনের অপেক্ষায় রয়েছে বহু ঘটনা ও ভাষ্য। এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসন্ধানী কাজ সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে, এমনি কাজের সূত্রে আমরা প্রবেশ করতে পারি ইতিহাসের আরও গভীরে, নতুনতর তথ্যের উদ্ঘাটন এবং তার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পেতে পারি অতীতের নিবিড়তর উপলব্ধি। জনপদের আসল ইতিহাস অথবা জাতীয় ইতিহাসের অভিঘাত কীভাবে জনপদে মূর্ত হয়ে ওঠে, তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যনির্ভর কাজ তাই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তেমন কাজ সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেও তা ইতিহাসের বৃহত্তর পটভূমি অনুধাবনে সহায়ক হয়, প্রচলিত উপলব্ধিতে যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা।
এ কথাগুলো বিশেষভাবে বলা হচ্ছে সাহাদাত পারভেজের ভবেরচর গণহত্যার বৃত্তান্ত পাঠান্তে, কেননা এই গ্রন্থ একাত্তরে সংঘটিত অজস্র নৃশংস হত্যাভিযানের মাত্র একটিকে ঘিরে প্রণীত হয়েছে। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অদূরবর্তী ভবেরচর অঞ্চলে হানা দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ ঘটায়, তার পূর্বাপর বিবরণ দিয়েছেন লেখক, বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছেন নয় কিশোরকে আটক করে নিষ্ঠুর অত্যাচারের পর তাদের হত্যাকাণ্ডের ওপর। গণহত্যার যে নিষ্ঠুরতা সেখানে চরম নৃশংসতার উদাহরণ মেলে ধরে শ্মশানঘাটের এই হত্যাকাণ্ড। অসহায় বালকদের বলাৎকার করার পর পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়ে তারপর গুলিতে-বেয়নেটে হত্যা করা হয়। পলায়নপর পাকিস্তানি বাহিনীর এমন নিষ্ঠুরতা যেন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে, কখনো হারিয়ে না যায়, তেমন এক তাগিদ থেকেই ভবেরচর অঞ্চলে ভূমিষ্ঠ ও লালিত লেখক ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর মাটি খুঁড়ে তথা মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে সবিস্তার তথ্য ও ভাষ্য নিয়ে সাজিয়েছেন তার বৃত্তান্ত। একটি মাত্র দিনের নৃশংস আক্রমণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্বাপর আরও অনেক ঘটনা। ভবেরচর এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে মহাসড়কের গুরুত্ব, সড়কের সেতু রক্ষা এবং সেতু ধ্বংসে উভয় পক্ষের মরিয়া লড়াই, এলাকাজুড়ে সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর দখলদার বাহিনীর নিষ্ঠুর হামলা এবং সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ—এসব নিয়েই ভবেরচরের আখ্যান।
গ্রন্থের তাৎপর্য আরও একদিক দিয়ে গুরুত্ববহ। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্যগ্রন্থ তথা একাত্তরের প্রজন্মের সদস্যদের দ্বারা প্রণীত গ্রন্থ আমরা পেয়েছি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়, তবে এই প্রাপ্তির ধারা ক্রমে হয়ে আসছে ক্ষীয়মাণ। ইতিহাস-উদ্ধার ও ত🍃ার নতুন পাঠগ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে মুক্তিযুদ্ধের൲ পরে জন্ম-নেওয়া প্রজন্মের সদস্য-সদস্যাদের। সাহাদাত পারভেজ তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশৎ বার্ষিকীতে আকাশে উড়ুক নতুনের কেতন, ইতিহাস সন্ধানে তারা পৌঁছে যাক জনপদ থেকে জনপদে, আলোকিত বৃত্তের বাইরের অগণিত সাধারণজনের অন্তরে। এভাবেই সার্থকতা পেতে পারে বাঙালির মুক্তিগাথা রচনার প্রয়াস। আশা করি, এমনই প্রয়াস হিসেবে পাঠকের সহৃদয় মনোযোগ লাভ করবে এই গ্রন্থ।
গণহত্যার গহন গল্প : প্রসঙ্গ ভবেরচর
লেখক : সাহাদাত পারভেজ
প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ
প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ : আনিসুজ্জামান সোহেল
দাম : ২৫০ টাকা