বাগেরহাটের মোংলা সমুদ্রবন্দরে সকাল ১০টায় পাকিস্তানি গানবোট থেকে গুলি হয়েছে ৩ এপ্রিল। কালো পতাকা ওড়ানো ছিল, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো বন্দর। মোংলা থেকে ১০ মাইল উত্তরে বাতাসে বিস্ফোরণের ধাক্কা লাগছে রামপাল থানার মালীডাঙ্গা গ্রামে। সেখানে মামাবাড়িতে রয়েছি পরিবারসহ। একটানা গুলি হয়েছে দীর্ঘক্ষণ।𓆉 দখিনা বাতাসে দুপুরবেলা উড়ে আসা ছাই ধরতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম, ক্যারোলিন, সুতি, পলিয়েস্টার; বয়স এগারো।
খুলনা থেকে মোংল🃏া নদীপথ ঘুরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম বাগেরহাট শহরে আক্রমণ করেছিল ২৪ এপ্রিল। গানবোট থেকে সেদিনও গুলি হয়েছিল মোংলা নদীর দুই তীরে রামপাল থানার আশপাশে। বৃদ্ধা এবং শিশুরা প্রচণ্ড গরমে নিরাপদ দূরের পথে নেমেছে। তারা আমাদের গালাগালি এবং অভিশাপ দিচ্ছিল হিন্দু হয়েও বাড়িতে আরামে অবস্থান করছি বলে।
সমবয়সী মুসলমান বন্ধুরা হঠাৎ অন্য রকম হয়ে গেল। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে আসছিল ঘন ঘন। গোয়াল থেকে গরু-বাছুর ধরে নিচ্ছিল, ঘর থেকে তৈজসপত্র, যা সামনে পাচ্ছিল তাই। অপরিচিত দাড়িওয়ালা কিছু ꦜলোকও এসেছিল। তাদের ম🐎ুখে ছিল রাগ, ক্রুদ্ধ মেজাজের বহিঃপ্রকাশ; হাতে রামদা। তারা আমার সম্মানিত দাদু বা বাবা কাউকেই পরোয়া করছিল না। মনে হচ্ছিল আমরা সবাই ভীষণ অপরাধী। তারা সরাসরি ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র ধরে টান দিয়ে ভেঙেচুরে ফেলছিল এবং পছন্দের কিছু নিয়ে চলে যাচ্ছিল মাথা উঁচু করে। ছোটরা বয়স্কদের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম, তারা না দেখার ভান করছিল; ব্যস্ত ছিল অন্য কিছু নিয়ে। তিল তিল করে গড়া একটা সাজানো বনেদি সংসার চোখের সামনে নির্মমভাবে ভেঙে পড়ছে দেখেও তারা কেন ভাবলেশহীন, তা-ও বিস্ময়কর লাগছিল! পরে বুঝেছি জিনিসপত্রের চেয়ে বেশি সংশয় দেখা দিয়েছিল জীবন নিয়ে। কী একটা ঘটেছে, তাই হিন্দুদের ওপর নেমে এসেছে এমন নির্যাতন! হিন্দু হওয়াটাই তখন বড় অপরাধ, সেই বার্তা বুঝিয়েছিল কেবল পরিস্থিতি। এই প্রথম অতি অদ্ভুত রকমের ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গেল সমস্ত বাস্তব এবং কল্পজগৎ!
রামপালে ৬ মে শান্তি কমিটি গঠনের মিটিং হলো। উপস্থিত ছিল বাগেরহাটের রাজাকার নেতার🐭া। ডা. মোজাম্মেল হোসেন, মোসলেম ডাক্তার, রজ্জব আলী ফকিরসহ কয়েকজন। রজ𒈔্জব আলী ফকির সরাসরি ঘোষণা করে, ‘গুলি করো আর হত্যা করো। আমি আজ সকালে চারটা খুন করে এসেছি। এই পরিস্থিতিতে আমি স্পষ্টভাবে একটি কথাই বলতে চাই, দেশকে রক্ষা করতে হলে হিন্দুদের নিধন করতে হবে, বিতাড়ন করতে হবে।’ মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন বাড়ির পাশের যুবক ইসলাম মৌলভী। বিকালের দিকে রাস্তা দিয়ে চিৎকার করে দৌড়ে আসেন তিনি, ‘হিন্দুরা পালাও, আর রক্ষে নেই।’ বাবা খবর শুনে ঘরে এসে বলল, ‘হাঁটো।’ প্রথমবার গৃহত্যাগ করলাম বৃহস্পতিবারের বারবেলায়।
ঝনঝনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী ভরসা দিয়েছিলেন, ‘আমি থাকতে আপনাদের কোনো বিপদ হতে দেব না।’ মিটিংয়ের পর তিনি আর দায়িত্ব নিতে ভরসা পেলেন না। সুন্দরী বড়দি রীতাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি। প্রতিবেশী ইসলাম মৌলভীর পরিবার থেকে ধর্ম ত্যাগের পরামর্শ পাঠিয়েছে। দিদিকে ইসলাম মৌলভীর সঙ্গে বিয়ে দিলে এ যাত্রা রক্ষা হয়। তারপর ইসলাম মৌলভীর উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। সেই উঠোনে বহুবার গিয়েছি, খেলা করেছি। আজ অন্য রকম, অপরিচিত মনে হলো। নতুন কুটুম্বুর মতো রহস্যময় যত্ন করছিল মহিলারা। বাবার পিসি-শাশুড়ি ক্ষেমঙ্করী বিশ্বাসের সাহসী ভূমিকায় আমরা ইসলাম গ্রহণ এবং বিয়েতে না গিয়ে ভারতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পথ ছি꧃ল ওই দুটো— ভারতে যাও, না হলে মুসলমান হও। অনতি দূরে ভাগার মাঠে যেতেই চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী ছুটে এলেন। ‘আজ অবর বেলায় যাবেন না। পরে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।’ ফেরার পথে একদল লুটেরার সামনে পড়লাম। তাদের হাতে মামাবাড়ির সব তৈজসপত্র। ফিরে এসে নিজেদের বাড়িটাই অচেনা মনে হলো। খাঁ-খাঁ করছে অদ্ভুত এক শূন্যতা; কয়েক ঘণ্টা আগেও গোলাভারা ধান-চাল ছিল অথচ পরদিন সকালে রান্নার জন্য কিছু চাল-ডাল পাঠাতে হলো চেয়ারম্যানকে। মা একটা ভাঙা মাটির হাঁড়ি সংগ্রহ করে তাতে একসঙ্গে সব সেদ্ধ করল। এভাবে আরও দুই তিন দিন পরে ভারতের উদ্দেশে আবার যাত্রা করি একদিন সকালে।
গ্রামগুলোতে লোকজন নেই। ভালো বাড়িগুল♚োতে বসে আছে দখলদাররা। লুটেরাদের শক্ত করে লুঙ্গি কাছা আঁটা। কিছু লোকের হাতে বন্দুক, রামদা, বড় ছুরিকা। পুকুরে ডুবে কাঁসা-পিতলের থালা-গ্লাস তুলছে ঝনঝন করে। ভেজা গায়ে ছুটে ছুটে লুটের মাল বয়ে নিচ্ছে বাড়ি। পথে তাদের ছুটতে বাধা হওয়ার ভয়ে আমরা মাটির রাস্তার নিচে দিয়ে হাঁটছি।
পশুর নদের তীরে মৈদাড়া গ্রামে পৌঁছালাম ১২ মে। ওপারে খুলনার দাকোপ থানার বাজুয়া বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় একশ ভারতগামী লোককে গুলি করে হত্যা করল সেদিন। নদী পার হওয়া গেল না। বিদায়ের আগে দাদু দুই দিন অনাহারে শুয়েছিল, দেশত্যাগ করবে না। যাত্রার সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল এবং এ সময় দলছুট হয়ে হারিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে মৈদাড়া গ্রামে নগরবাসী দাসের বাড়িতে থাকলাম দুই দিন। নগরবাসী দাস হোমিও চিকিৎসক। এলাকার সবাই তার উপকারভোগী। সেখানেও একই চিত্র; যুদ্ধ, মিলিটারি, পুলিশ কিছুই না, পক্ষ দুটি; হিন্দু আর মুসলমান! দল বেঁধে দেশি অস্ত্র হাতে চলে আসছে মাঝে মাঝে আর প্রথম দিকে একটু সমীহ নিয়ে বলছে, ও ডাক্তার, নিয়ে যাই? তিনি অনুরোধ করছেন, দু🐈দিন পর সব রেখে চলে যাব, নিয়ে যাস তখন। কিন্তু না, আড়꧒ালে থেকে তাদের মুখের সেই সমীহ ভাবটা আর দেখলাম না। ঝুর ঝুর করে হাজার হাজার ছোট ওষুধের শিশি ভেঙে পড়ল দামি কাঠের নকশা করা আলমারি টেনে নিয়ে গেলে। ডা. অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন গড়িয়ে পড়া ওষুধের স্রোতের দিকে তাকিয়ে।
দুই দিন পর পশুর নদ পার হয়ে পৌঁছালাম চুনকুড়ি। সেখানকার চেয়ারম্যান অনন্ত মণ্ডলের বাড়িতে শত শত মানুষ। পরদিন ভোরে চেয়ারম্য💖ানের তত্ত্বাবধানে কয়েক শ নৌকায় চড়লাম হাজার হাজার শরণার্থী। শিবসা নদীজুড়ে আগেপিছে যত দূর চোখ যায় শুধু নৌকা।
এক সপ্তাহ পরে বদরতলার বাজারে নামলাম বিকেলে। রাতে বাজারে অবস্থান করে ভোর ৪টায় হাঁটা শুরু হলো। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঝাঁকা-বাঁকে করে বয়ে নিচ্ছিল লোকজন। আসলে বুঝতে পারছিলাম না এটা কী হচ্ছে! রাস্তার পাশে অনেককে বসে কাঁদতে দেখলাম। তাদের ফেলে গেছে আত্মীয়রা। একরকম দৌড়ে বেলা ওঠার আগেই আশাশুনি-দেবহাটা মিলি𝓀টারি চলাচলের বিপজ্জনক রাস্তা পার হলাম সবাই। ক্লান্তিতে শিশু এবং বৃদ্ধরা গড়িয়ে পড়ছিল কিন্তু থামবার উপায় নেই।
সকাল আটটার দিকে সীমান্ত পার হচ্ছি গৃহত্যাগের ১৫ দিন পর। টাকির বর্ডার পার হয়ে সমস্ত ক্লান্তি নেমে এলো তবে স্বেচ্ছাসেবকরা বসতে দিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির আওতার বাইরে যেতে হব🌠ে। এমন সময় প্রচণ্ড গুলির শব্দও শুনলাম। কিছুক্ষণ পর অনেক আহত ও রক্তাক্ত মানুষকে দেখলাম ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। পেছনে যারা আসছিল তাদের ওপর গুলি হয়েছে। আমরা টাকির আমবাগানে গিয়ে আস্তানা গেড়ে বসি। ভয়ানক ভিড়ের মধ্যে ছোট ভাই টুলু হারিয়ে গেছে! বড়দা পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়ে গেল মোংলায় পাকিস্তানে! বাবা কিছুটা পাগলের মতো আচরণ করছে।
খুলনা-বাগেরহাটের শরণার্থীরা প্রায় সব সাতক্ষীরার দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে বর্ডার পার হচ্ছিল। ফলে আমার মামা মণিক♑ান্ত বিশ্বাস এবং মাসিমা তারা বিশ্বাস বশিরহাট, টাকি অঞ্চলে আমাদের খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল শরণার্থীদের ভিড়ে। তারা আগে থেকে ভারতে ছিল। পরদিন সেখানে পেয়ে গেল আমাদের। আমরা একটা নতুন জীবন পেলাম। কেউ আর লুট বা হত্যা করতে পারবে না।
ভয়ানক গাদাগাদি করে একটা তিন চাকার টেম্পোতে চড়ে বশিরহাট, সেখান থেকে বাসে করে রাতে পৌঁছালাম বারাসাত-বারাকপুরের মাঝখানে নীলগঞ্জ। বাসস্ট্যান্ড থেকে ডান 💎দিকে একটা রাস্তা। সামান্য দূরে পিচঢালা পথের ডান দিকের বাঁকটা ঘুরেই বাঁ হাতে একটি আধা পাকা ঘর। প্রথম রুমে একটা মুদিদোকান। মাঝখানের রুমে তারা মাসি ভাড়া থাকে। সেখানে সবাই উঠলাম। দুইজনের কক্ষে ১৫ জন। তার মধ্যেই রান্না-খাওয়া।
পথে-ঘাটে, বাসে-বাজারে জয় বাংলার লোক। পাকিস্তানি সেনার চেয়ে মুসলমানদের ওপর তাদের বেশি ক্রোধ। প্রতিবেশী মুসলমানরা লুট ও নির্যাতন করেছে। মাসিমার ইন্ধনে মুসলমানদের ক্ষেত থেকে শাকসবজি চুরি শুরু করলাম। মাসিমা দেখিয়ে দিল কোনটা হিন্দু আর কোনটা মুসলমানদের ক্ষেত। রাস্তার পাশে ঘর বাঁধার জন্য শরণার্থীরা দল বেঁধে বাঁশ কেটে নিতে লাগল মুসলমানদের বাগান থেকে। মুসলিম পরিবারগুলোতে শুরু হলো হামলা। তখন নীলগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পাশে আয়োজিত হলো সর্বদলীয় একটা মিটিং। কংগ্রেস, সিপিএমসহ কয়েটি দলের নেতারা ভাষণ দেন। একজন বললেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তা বলে এখানে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করা চলবে না। শেখ মুজিবের নাকে গরম জল ঢালা হচ্ছে। তিনি বাঁচবেন কি না ঠিক নেই। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা-ও বোঝা যায় না। আপনারা যদি মুসলমানদের ওপর এসব বন্ধ না করেন, তবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেব।’ এরপর সাধারণ লুটপাট কমে গেলেও মুসলমানদের ওপর ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। আত্মীয় একজন ট্রেনিংয়ের মিলিটারি জুতা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলেন। তাকে ঘিরে গল্প শুনলাম আর জুতা দেখলাম। পাকিস্তানি সেনা যেন তেন, ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন লুটেরা আর নারী নির্যাতনকারী মুসলমানদের হত্যা করতে।
বাসার কাছে রাস্তার মোড়ে একটি মুসলমান বাড়ি। ঘুটে কিনতে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলাম কয়েক দিন। লতা-পাতায় ঢাকা পুরোনো বাড়িটার দেয়াল নুনেধরা। কাঠের কালো ও পুরোনো দরোজা ঠেলে ঢুকতে হয়༺। রাস্তার দিকে একটা দোকান। ফর্সা, খুব অমায়িক বাড়ির মালিক দোকানে বসেন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে ডাকাতি হলো সে বাড়িতে। নিরীহ মানুষগুলোকে আহত করার কষ্টে মাথার মধ্যে ঘিলু নাড়িয়ে দেওয়া দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটা শুরু হলো। কোনো অপরাধ নেই, কোনো অন্যায় করেননি বরং অত্যন্ত মার্জিত ছিল তারা কিন্তু মুসলমান যে! গভীর এক মনঃকষ্টে একা একা ভুগলাম দীর্ঘদিন।
আমাদের রেশন কার্ড দিগবাড়িয়া ক্যাম্পের, তুলতে হয় দমদম ক্যাম্প থেকে। বারাসাতের ওপর দিয়ে যাতায়াত। বারাসাত থেকে ট্রেনে নিউ বারাকপুর নেমে হেঁটে যাই। দমদম ক্যাম্পটা বিশাল। প্রতি মিনিটে একখানা বিমান ওঠা-নামা দেখি। এই ক্যাম্পে মুসলিম শরণার্থী ছিল। সিনেটর জন এফ কেনেডি এসেছিলেন এখানে। বিদেশিদের দেখানোর জন্যই বিমানবন্দরের কাছে বড় ক্যাম্প। এক মুসলিম বৃদ্ধা তার পরিবারে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। মানুষের মৃত্যু আর কান্না খুব মামুলি হয়ে পড়েছিল। বৃদ🐼্ধার স্বামী-সন্তানকে হত্যার পর পুত্রবধূকে তার সামনে নির্যাতন করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ কথা বলে তিনি বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে ওঠেন। লাশ, কাদাময় কালো পলিথিনের ঘর, হাড় জিরজিরে উলঙ্গ শিশু, বিস্তৃত জায়গা নিয়ে তরল মল— এসবের ছবি তোলে বিদেশি সাংবাদিকরা।
দী♐র্ঘ লাইনে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে রেশন তুলতে হয়। বাবা আর আমি পালা করে দাঁড়াই। বহু লাশ চোখে পড়ে ক্যাম্প এবং রাস্তার পাশে। ময়লা কাপড়ে এবং পাটিতে জড়ানো পড়ে রয়েছে সারি সারি। আমাশয়, অপুষ্টিতে মরছিল বেশি মানুষ। নোংরা স্যাঁতসেঁতে স্থানের জন্য হাত-পা ফুলে মারা যেত মহিলারা। মরলে কেউ কাঁদে না।
খরচ কমাতে দিগবাড়িয়া ক্যাম্পে চলে গেলাম অক্টোবরে। মধ্যমগ্রাম-বাদু রোডের দুই পাশে বস্তিঘর। আমরা পুব পাশে একটা জায়গা পেলাম ৮ বাই ১৬ ফিট। আধা ইঞ্চি ফাঁ🧔কা করে পাটকাঠি দিয়ে ঘর ছাইয়ে নিল বাবা। বড়রা দাঁড়াতে পারে না ঘরের মধ্যে, নিচু চাল। পাটি ও প্লাস্টিক দিয়ে বেড়া। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। অর্ধেকে রান্না-খাওয়া, অর্ধেকে খড় বিছিয়ে শোয়া। আমরা ছয় ভাই-বোন একসঙ্গে শুয়ে চাঁদ-তারা আর বিমানের ওড়াউড়ি দেখি। আমাদের পুবে আরেকটি ঘর, তারপরে বিল। রাতের বেলা যা হোক দিনের বেলা পায়খানায় যাওয়ার জায়গা ছিল না। নারী-পুরুষনির্বিশেষে ধানের চারার মধ্যে কাজ সারে। সেখানে জল-কাদা। আশপাশে বসতি নেই। উত্তর-পশ্চিমে প্রায় একশ বিঘায় একটা বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন। সারা দিন বাগান থেকে শুকনা কাঠ ও শাক-পাতা সংগ্রহ করি।
শীত এসে গেছে বেশ আগে। রাস্তার পাশে বসে অনেকে খবর শোনে ও পেপার পড়ে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তর্ক-বিতর্ক ওঠে। রাগারাগি হয়। কেউ বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে রাজাকা𒆙রের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে কিনা নজর রাখা হয় কড়াভাবে। মুসলমান কেউ এসেছে জানতে পারলে কঠিন জেরা এবং গণপ্রহারে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। একদিন সকালে রাস্তার পাশে খবর শুনছে সবাই। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের খবর হচ্ছে। ‘পাকবাহিনী বিপুল বিক্রমে পশ্চিবঙ্গের মধ্যম গ্রাম পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।’ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে কয়েকজন। ‘ভাঙ রেডিও’ বলে চিৎকার করে কেউ কেউ।
মাইকিং করে ক্যাম্পে রাতে আলো জ্বালতে নিষেধ করা হলো ৩ ডিসেম্বর। শত শত পিলারের মাথায় অভ্যস্ত আলো জ্বললো না বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে। ‘নিষ্প্রদীপ মহড়া’ কথাটা প্রথম শুনলাম। দিনেই রান্না শেষ করে সন্ধ্যার আগে খেয়ে নিতে হবে। গাড়ির হেডলাইটের ওপরের অর্ধেকে হলো কালো রং। রাস্তায় মিলিটারি বহনকারী লরির সংখ্যা বেড়ে গেল। প্রত্যেক লরির পেছনে তাঁবুতে ঢাকা কামান-মেশিনগান যুক্ত। তাদের দেখলে সকলে ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠে। তারাও ‘জয়𓆉 বাংলা’ বলে হাত নাড়ে। খোলা গাড়িতে বড় বড় নৌকা নিতে দেখলাম। যে নৌকা জলে আমাদের বহন করে, সেই নৌকা ডাঙায় গাড়িতে!
বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের পিলারে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ🍒্যায় হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। লোকজন ঘরের বাইরে চলে এলো। শোনা গেল বাংলাদেশ স্বাধীন! ক্যাম্পের লোকজন মিছিল নিয়ে রাস্তা দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কাঁ🍸পিয়ে তুলল আকাশ-বাতাস। থেমে গেল জঙ্গিবিমানের শব্দ। আমরা আনন্দে কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। রাতে শুয়ে আকাশ দেখলাম। আবার একটা যাত্রার হাওয়া শুরু হলো হঠাৎ। দিগবাড়িয়া ক্যাম্পের শরণার্থীদের দেশে ফিরতে দেরি হলো প্রায় আড়াই মাস। তখনো যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের মুহূর্তটা বিস্ময়কর। সে অনুভূতি ব্যাখ্যাতীত। সীমান্তে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ভারতের সীমান্তজুড়ে এবং আধা মাইল ভেতরে দুই পক্ষের পরিখা। ট্যাংকগুলো যেখানে সেখানে পড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে পোড়া। রাস্তায় মানুষজন কম। পোড়া বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ভাঙা। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে গেলাম। রাতে খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে নামিয়ে দিল আমাদের মধ্য মার্চ ১৯৭২।
বাবা ভোরে খুলনা লঞ্চঘাটে গিয়ে টাবুরে ভাড়া করে এলেন একশ টাকায়। সারা﷽ দিন ও রাত চলল নৌকা। রাতের বেলা ভয়ংকর এক নিস্তব্ধতার মধ্যে চলেছি। দেশে কোনো মানুষ আছে বোঝা যায় না🍸। দূরে কিছু আলো দেখা যায়। নৌকা যখন মামাবাড়ির ঘাটে পৌঁছাল তখন ভোর চারটা। প্রত্যেকে হাতে বোঝা নিয়ে ফাল্গুনের ঈষৎ শীতলতায় কাদার মধ্যে নেমে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। বাড়ি চেনা যায় না। উঠানে গজানো লম্বা ঘাস আবর্জনার মধ্যে থমকে দাঁড়ালাম।
দেশে এসে♊ লুটপাট হত্যা-ধর্ষণের ভয় সব ভুলে গেলাম কিন্তু অবচেতনে জেগেছিল বলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে চিৎকার করে উঠতাম মাঝে মাঝে। মা আমাকে হেই হেই করে জাগিয়ে প্রতিবার জিজ্ঞাসা করত কী হয়েছেরে? ‘অস্ত্র হাতে মুসলমানরা তাড়া করেছে’ বলতাম না। বলতাম, স্বপ্ন দেখেছি। আমার বালক মনের এই ট্🅠রমা কত কষ্টের, তা অন্যকে বোঝানো যায় না। আমি ভাবতাম, লুটপাট তো মুসলমানরা করেছে কিন্তু কেউ তো সে কথা বলছে না! বয়স ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে লুটেরা হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নিজেদের দাবি করে কিন্তু ঢালাওভাবে ওই দুই সম্প্রদায়কে দোষ দেওয়া যায় না। আমি সত্যিকার অর্থেই সাম্প্রদায়িক অ্যালার্জির রোগী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। বর্বর পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দৈশিক দোসরদের সৃষ্ট আমার ট্রমা নিরসনের জন্য কেউ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি আজও; না সমাজ না রাষ্ট্র!
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক