পৃথিবী কমলালেবুর মতো নীল অথবা "গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কবিতা"

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ০৩:৪৮ পিএম

ওবিগত ১৬ অক্টোবর (২০২৪)  ‍‍`গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কবিতা‍‍` নামে একটা বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পুনর্জীবিত জাতীয় কবিতা পরিষদে। ঐদিন সকালেই আমাকে সেই বক্তꦛৃতার একটা সারমর্মও লিখে দিতে হয়েছিল। এখানে সেই সারমর্ম । সঙ্গে কিছু অসার কথাও যোগ করলাম ।

 

১।। কবিতার গড়ন

ফরাশিদেশের কবি পল এলুয়ার একবার লিখেছিলেন: "পৃথিবী কমলালেবুর মতো ন꧋ীল"। এই এক পংক্তি পড়লেই বোঝা যায় মানুষ কেন কবিতা লেখে অর্থাৎ কবিতা কি কাজ করতে পারে ।

কবিতার কাজ ভাষার প্রকাশ-ক্ষমতা বাড়ানো । কবিতা ভাষার সীমান্ত ঠেলতে পা📖রে । এই বাড়তি ক্ষমতার  বলেই কবিতা সঙ্গে সঙ্গে না হোক দুদিন আগে বা পরে সর্বসাধারণের বিষয় বা সম্পদ হয়ে ওঠে ।

বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ কোথাও বলেছিলেন "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি" । এই বলনটা ൩যুগপদ সত্য ও অসত্য । সত্য সংকীর্ণ  অর্থে আর অসত্য ব্যাপক অর্থে । মানুষ মাত্রেই কবি কারণ ভাষা মাত্রেই কবিতা । রূপক ও লক্ষণা (মেটাফোর ও মেটোনিমি) নামক দুই অলঙ্কার ছাড়া কোন স্বাভাবিক (ন্যাচারাল) ভাষাই কাজ করে না । কবিতার মূল অলঙ্কারও এই দুইটাই । তাই বলা চলে ভাষা মাত্রেই কবিতা । যা কবিতা নয় তা স্বাভাবিক ভাষা নয় । কবিতা বা কবি শব্দের ব্যুৎপত্তি বিচার করলেও "কওয়া" পর্যন্ত যেতে হবে । কথা ও কবিতা মোটেও অসবর্ণ নয় ।

এ তো গেল ব্যুৎপত্ꦬতির কথা। নিয়তির বিচারেও ভাষা ও কবিতা মনে হয় 𝄹সহোদর বোন । কবিতা হয়তো এই দুনিয়া বদলে দেবে না কিন্তু কবিতা ছাড়া এই দুনিয়ার আর কোন  বিহিত, গন্তব্য বা নিয়তি নাই ।

তাই এই বক্তৃতায় স্থির করলাম কবিতার সঙ্গে, ꦺকিংবা যদি বলেন কবিতা প্রসঙ্গে, দুইটি কথা বলবো । একটা কবিতার যাত্রাবিন্দু নিয়ে, আরটা তার বিহিত, গন্তব্য বা নিয়তি নি🃏য়ে ।

যাত্রাবিন্দুর কথা দিয়ে শুরু করতে পারি । অর্থের অর্থাৎ ভাবের বিচারে  কবিতা আর গণতন্ত্র সমার্থক । যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না তা ভাষা নয়। নীরব কবিত্ব বলে কিছু যেমন নাই তেমনি অপ্রকাশ্য কবিত🧜া বলেও কোন কবিতা নাই । কবিতার সঙ্গে ভাষার যোগ নাড়ির যোগ বটে । আর মানব সমাজে ভাষার চেয়ে অধিক গণতান্ত্রিক কোন সম্পদ নাই । এই শর্তানুসারে কবিতা মাত্রেই গণতান্ত্রিক ।  

 

২।। কবিতার চলন

কবিতা আরেক অর্থেও গণতান্ত্রিক । এই অর্থ ইতিহাসের অর্থাৎ কালের বিচারে নিষ্পন্ন । কালের গর্ভে ভাষার  পর🥂িবর্তন নিষিক্ত হয় । এই🍸 নিষিক্ত হওয়া অঘটন নয়, ঘটনা । কারণ তা নিয়মিত ঘটে ।

এই ধরণের সকল বিপ্লবের নিয়তিকে কবিতার সঙ্গে তুল🎶না করা যায় 💮। পৃথিবীতে যত ঘটনা ঘটে তার সব কটাকেই বিপ্লব বলা চলে না। মাত্র  কোন কোনটাই বিপ্লব ।

কোন ঘটনা বিপ্লব পদবাচ্য হল কিনা তার একটা মাপকাঠি আছে✅: ঘটনাটি কয়টা কবিতা পদবাচ্য কবিতার (অর্থাৎ সামান্য অর্থে সৃষ্টির) জন্ম দিতে পেরেছে ।

যাত্রাবিন্দুর মাপে কিংবা ভাবের বিচারে গণতন্ত্র কথাটার আদি অর্থ ছিল দশের বা সর্বসাধারণের  কর্তৃত্ব"। আগেই স্বীকার করেছি কবিতা জন্মগ্রহণ করার দুদিন আগে আর পরে  জনগণের অর্জ🎀িত সম্পদ হয়ে পড়ে । এখানেই ধরা পড়ে কবিতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কটা কতকটা আঁতের সম্পর্ক ।

যাহা জনগণের বা সংক্ষেপে꧟ গণের, যাহা সকলের (অর্থাৎ দশজনের), জাতীয় সমাজে তাহার উপরে আর কোন ধন নাই--এই ধারণাই  একদা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বলে গণ্য হতো । তাহা ভালো না মন্🌠দ এ নিয়ে কোন ঐকমত্য ছিল না । গ্রিসদেশের মনীষী আরস্ত মনে করতেন গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিকৃষ্টতম শাসন ব্যবস্থা ।

কালের গতিকে আরস্তুর ব্যবস্থাপত্র ধোপে টেকেনি । আরস্তুর মতো মনীষীরও মতিভ্রম হয়েছিল । যাহা দেশের জনসাধারণের সম্পদ তাহা মাত্র হাতেগোনা ক‍‍`জন ভূস্বামী বা ধনকুবের আর কয়েক গণ্ডা সামন্ততন্ত্র  বা ধনতন্ত্র-সেবকের হাতে বন্দী থাকব🐽ে এমন তো হতে পারে না। অন্তত চিরদিন হতে পারে না । দশজনের ধন ভাষার মতো রাষ্ট্রও চলবে দশজনের ইচ্ছা অনুসারে-এই অঙ্গীকারই ছ𒁃িল গণতন্ত্রের প্রথম প্রতিশ্রুতি বা আদিকল্প।

কবিতা এই আদি ও আসল ঐতিহাসিক অর্থে ছিল গণতান্ত্রিক । কবিতা যে ভাষায় লেখা হয় সে ভাষার মালিকানা ঐ ভাষায় যারা যারা কথা কহেন বা লেখেন তাদের সকলের । প্রকৃত প্রস্তাবে কবির বাসনা বা কামনাও তা ছাড়া আর কিছু নয় । পৃথিবীর বাতাস আর আকাশের আলো, মহাসাগরের পানি আর নক্ষত্রমণ্ডলীর শোভা যেমন সকলের, জীবনের অপরিহার্য আর সকল বিষয়-সম্পদও তেমনি সকলের । সারাৎসারস্বরূপ এই বিবেচনা ছাড়া কবির বাসনা আর কিছু হয় না﷽ !

কবিতা মাত্রেই𒆙 তাই গণতান্ত্রিক । এই সত্যের একনম্বর কারণ কবির কারবার । আর এই কারবারটা ভাষা  নিয়ে চলে । এক ব্যক্তির ভাষা বলে কিছু নাই।  এই জগতের কোথাও কোন পদার্থ🌄ের ক্ষুদ্রতম কণাও পাওয়া যায় নাই যাহাকে এক ব্যক্তির ভাষা নাম দেওয়া যায় ।

মানুষ যে মানুষ (তার মধ্যে মনের ঊষ) হয়েছে তা মাতꦓ্র এই ভাষা বা বাকশক্তির কারণে । ভাষা আর মন মানুষের ক্ষেত্রে সমান ♌অর্থপাত করে ।

তারপরও স্বীকার করতে সকলেই এই প্রস্তাবের অনুগমণ করবেন না ।  ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন ভাব প্রকাশের দুঃসাহস যাঁরা করেন সঙ্কীর্ণ অর্থে তাঁরাই যখন কবি তখন জীবনানন্দ দাশের কথাই সত্য: সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি ।
এখানেই দেখা যায় অনেক কবি আছেন যারা ♊গণতান্ত্রিক বললে অপমানিত বোধ করেন । গণতন্ত্র এঁদের ভাষায় "জনতার জঘন্য মিতালি" ।


৩।। ইতিহাস বা নবযুগপুরাণ

পরিশেষে কবিতার নিয়তি বা গন্তব্যের কথা বলি। নিয়তির♈ একটা মানে যাহার রতি আছে কিন্তু যতি (সংস্কৃতে "য়তি") নাই । এই অর্থে কবিতার কোন উপসং💖হার নাই ।

দুঃখের মধ্যে মানুষের অভিজ্ঞতার নিরিখে, কালের বিচারে,  ইতিহাস পুরাণ অনুসারে কবিতার সঙ্গে গণতন্ত্রের একটি সম্পর্ক আছে । এই সম্পর্ককে পৌরাণিকও ♍বলা যায় । তবে আধুনিক কালে ইতিহাস যখন প্রাচীন পুরাকথা বা মিথের স্থান দখল করেছে, তাই ইতিহাস সম্পর্কে একটু সাবধানতার দরকার আছে। ইতিহাস এখন পুরাণের অভাব পূরণ করছে ।

গত দুই শত বছ🍌রে🎶র কথাই যদি ধরি কি দেখি?  দেখি দুনিয়ার শত শত বড় কবি গণতন্ত্রের সংগ্রামে শরিক ছিলেন । জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন বা প্রগতিই ছিল এই মহান কবিকুলের সাধনা । এই সাধনা কোথাও সার্থক হয়েছে, কোথাও বা হয়েছে নিরর্থক ।

সুখের মধ্যে এই ভাগ্যোন্নয়নসন্ধানী কবিতা ভাষার ঢের নতুন সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছে । যে বেদনা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না, মূক হয়েꩵ থাকি, মূষড়ে পড়ি কবিতার মধ♍্যে  কবিতার কালোয়াতগণ সেই বেদনাকে ভাষা দিয়ে থাকেন । তাই জনসাধারণ কবিতার এত আদর করেন । কবিতার গন্তব্য বা নিয়তি তাই জনসাধারণ ।

কোন সে জনসাধারণ ? যে জনসাধারণ শেষবিচারে দু🔯নিয়ার মজদুর আর দুনিয়ার মজলুম ♓তারা ছাড়া আর কে নিজেকে জনসাধারণ বলতে রাজি হয়েছে! বিশেষ কি আর সাধারণ হয়!

ইতিহাসের বর্তমান পুলাণ বলে, যাদের নিজ নিজ গতর আর 💃স্ব স্ব রতিশক্তি  ছাড়া আর কোন (বেচে খাওয়꧟ার  মতো সামগ্রী বা বাঁচবার মতো উপায়-উপকরণ নাই) তারাই জনসাধারণ ।

এই জনসাধারণের যুগ যেদিন শুরু হয়েছে সেই যুগকেই মাত্র গণতন্🌃ত্রের যুগ বলা যায় । এই যুগের জন্ম কখন  হয়েছিল সেটা বড় কথা নয় । আসল কথা, আমরা সে যুগের গর্ভেই জন্ম নিয়েছি । জার্মানির কবি বের্টোল্ট ব্রেশ্ট এই যুগের বেদনা সারাজীবন প্রকাশ করা যায় না এমন ভাষায় প্রকাಌশ করেছিলেন ।  এক্ষণে তাঁহার অসামান্য কথার সামান্য ব্যয়ভার বহন করছি।

"এখন যে সমাজ-ব্যবস্থা চলছে
তা উৎখাত করার ডাক আপনার চোখে ভয়ঙ্কর ঠেকতেই পারে,
তবে যা চলেছে তা তো মোটেই  সমাজ-ব্যবস্থা নয় ।

সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া
হয়তো মনে হবে অশুভ ।
কিন্তু দিনের পর দিন যা ঘটে চলেছে
তা তো সশস্ত্র সংগ্রামই !
এতে অবাক হবার কিছু নেই।"

ইউরোপখণ্ডে হজরত ঈসার ১৫০০ বছরের আগেপিছে এক যুগ শুরু হয়েছে । সে যুগের দুই চরিত্র । এক চরিত্র স্বখণ🐻্ডে হোক না হ🦄োক  সমাজ ব্যবস্থা। আর পরখণ্ডে (আমেরিকা, আসিয়া আর আফ্রিকায়) সশস্ত্র সংগ্রাম । তাই কবিতার ইতিহাসেও  এই দ্বিচারিতা গোপন থাকেনি ।

১৯৪৮ সালে ফরাশি দেশের রাজধানী পারি শহর থেকে প্রকাশিত একটি কবিতা সংকলন গ্রন্থের ভূমিকাযোগে জাঁ-পল সার্ত্র লিখেছিলেন: "এক কথায়, আমি এখন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকদের বলেকয়ে তাদের যা বোঝাতে চাইছি  তা তো কৃষ্ণাঙ্গরা আগেই জেনে ফেলেছেন : বর্তমান দশায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী কি কারণে কেবল কবিতাজাত অভিজ্ঞতা বলেই নিজেদের চিনতে পারছেন আর কথাটা উল্টিয়ে বললে এই দাঁড়ায়: কোন কারণে ফরাশি ভাষায় লಌেখা কৃষ্ণাঙ্গ কবিতাই আমাদের যুগের একমাত্র মহীয়ান বিপ্লবী কবিতার  (la seule grande poésie révolutionnaire)"  মর্যাদা লাভ করেছে ।

 

কবিতা সংকলনটির নাম: Anthologie de la nouvelle poésie nègre et malgache de langue française ( ফরাশি ভাষায় লিখিত নতুন কৃষ্ণাঙ্গ ও মালগাশ কবিতার সংকলন); 
সম্পাদকের নাম: Léopold Sédar Senghor 🦄( লিওপোল সেদার সঁগর)।

 

ঢাকা 
অক্টোবর ১৯, ২০২৪ ।।