আলম খান, আশা করেছিলাম আপনাকে ভুলবো না। তবে ভুলে যাওয়াই আমাদের অভ্যাস। তাই জোর গলায় বলতে পারছি না। তবে আপনাকে মনে রাখা উচিত ও মনে রাখতে চাইও। যেমন: আলাউদ্দিন আলীকে আমি মনে রাখতে চাই, তার কথা বলিও। এরকম গ্রেট সুরকার ও সংগীত পরিচালকদের কাজ নিয়ে স্মৃতি রোমান্থনও আনন্দের। এই লেখাটা যখন আমি লিখছি, আমি গুনগুন করে গাইছিলাম, ‘তুমি আমার কত চেনা সে কি জানো না।’ ছায়াছন্দে এই গানটা দে💫খে আমিও গরমের দিনে তোয়ালে কে মাফলার বানিয়ে এক্টিং করতাম। বাড়ি থেকে কেউ এলে এসব ছিল আমার শো-এর সিগনেচার মুভ। তারপর মিতা নূরের সেই নাচ, ‘আলো আলো বেশি আলো।’ বহুবার শোনা গান মনে পড়ে, ‘তুমি আজ কথা দিয়েছো’, গানটা সুন্দর তো অবশ্যই। মন দিয়ে শুনলে দেখবেন একদিকে ড্রামস আরেক দিকে তবলা। কি অদ্ভুত মিশ্রণ। আলম খান নীরিক্ষা ভালোবাসতেন, সাপের ছবিতেও তিনি দিয়েছেন মর্ডান পপ গান, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’! তিনি বিশ্বাস করতেন, চলচ্চিত্রের গান করতে হলে সব জানতে হবে, রক এন্ড রোল, রাগ সংগীত অথবা ফোক। জানতেন আর নতুন কিছু করার চেষ্টা করতেন বলেই তিন শর ওপরে সিনেমায় কাজ করেছেন। বিটিভি ও রেডিওর জন্যও হাজার খানেক গান তৈরি করেছেন।
সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির বাইরেও আমল খানের আসল কাজ শ্রুতিমধুর বাংলা গানের এক বিপুল সুরসম🔴্ভার রেখে যাওয়া। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মত গন্ধ বিলিয়ে যাই’। কি দুর্দান্ত গায়কী সাবিনা ইয়াসমিনের। অথচ গীতিকার মাসুদ করিমের সুরটা মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না। আলম খানও বললেন এই সুরে গান না করলে তিনি কাজ করবেন না। রেকর্ডিংয়েও গীতিকার অনুপস্থিত ছিলেন। পরে গানটা যখন ছবিতে সুপারহিট, তখন একদিন এসে মাসুদ করিম জড়িয়ে ধরলেন আলম খানকে। আলম খান সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে কয়েকটা ছবিতে কাজ করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক ও আমজাদ হোসেনদের প্রতিভা ছিল স্ক্রিপ্টের সাথেই গান লেখার। চার লাইন ‘হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস’ লিখে সুর করতে দেন আলম খানকে। পনের রকমের সুর করে একটা𝄹 ঠিক করেন আলম খান। সৈয়দ হকের সাথে পরে অন্তরা সুর করতে গিয়ে মনঃপুত হচ্ছিল না। সৈয়দ হক আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘পূর্নিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া’ এতে যে টানটা দিয়েছেন তাতেই আমার মন ভরে গেছে।
রকগুরু আজম খান খুবই মোটিভেটেড ছিলেন বড় ভাই আলম খানের সংগীতের দ্বারা। নিজের নাম আজম খানও সে সূত্রে রাখা। আজম খান শিখতেন গণসংগীত। যুদ্ধে যেতে চাইলেন, যেতে দেওয়া হলেন। আলম খানও চেয়েছিলেন ওনাকে যেতে দেয় নাই। বলা হলো, সবাই যুদ্ধে গেলে এ পরিবার ও দুটো বোনকে দেখ🔥বে কে? তিনি পিটিভির কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। একটা সরকারি চাকুরে মধ্যবিত্ত পরিবার কিভাবে একাত্তরে ঢাকায় সারভাইভ করছে সেই ব্যাপারটা বোঝা যায় এসব ঘটনায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলম খান যখন খ্যাতির চূড়ান্তে, তখনও আজম খান নিজের কথা কখনো বলতেন না। বরং তার বন্ধুদের আনতেন আর ব🐼লতেন, ‘ভাইয়া ছেলেটা ভালো গায়, একটু শুনে দেইখেন।’ তেরোই ডিসেম্বর ১৯৭১, আলম খান আর তার ভাই, বাবাকে দাঁড় করানো হয় বাসায় লাইন দিয়ে। আলম খানের বাবা উর্দুতে কলেমা পড়ার সময় চান। তারপর দাঁড়িওয়ালা এমন মুরুব্বিকে দেখে তাদের মায়া হয়। না মেরেই চলে যান। আলম খানের মনে হতো যে জীবনটা পার করছেন, বোনাস লাইফ এবং তা গানের জন্যই নিবেদিত। এসব গল্প শুনবেন কম। একাত্তর কি প্রভাব রেখেছিল এ দেশের জনজীবনে।
আলম খান কাজ করে গিয়েছেন, সিনেমায় রুচিশীল সংগীত নিয়ে। শেষে টিভিতে এসে আফসোস করতেন, এ যুগের গান নিয়ে। বাজারি গান যে তারা করতেন না তা নয়। কিন্তু তাদের বাজারি গানেও একটা রুচিশীলতার ছোঁয়া থাকতো। ফরীদি অভিনীত, ‘তোমরা কাউকে বলো না’ গানটির কথাই ধরেন। নাচে গানে অভিনয়ে কি অন্যরকম একটা গান। কিংবা অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত গান, ‘মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শোনাবো গান।’ এখনও শুনতে বসলে কি ভালো লাগায় ভরে যায়। আরেকটা গান দিয়েই শেষ করি, চিরায়ত বিরহের গান, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’। জহিরুল হকের ‘কেউ কারো নয়’ ছবির এ গানটা আমি যখনই শুনি তখন মনে হয় এত কোটি কোটি মানুষের অন্তরের কথা, কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপ, পেয়েও হারানোর অভিমান থেকে উপলব্ধি। এর বিপরীত গানটাও আলম খানের সুর করা, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’। সংগীত জগতে সে ভালোবাসা বিলিয়ে নিয়েই আলম খান চলে গিয়েছেন ২০২২ সালের এই দিনে। বাংলা সিনেমা যতদিন থাকবে ততদিন তাঁকে মনে রাখতেই হবে।