অঞ্জন দত্তের গান দিয়ে দুনিয়া দেখা আমাদের। তিনি যে ছবি করেন, অভিনয় করেন, এসব আমাদের যৌবনে জানা। তার আগে পরে অঞ্জন মানে শুধুই গান। এখন আমি অঞ্জন দত্তের গানকে যত ক্রিটিকাল প্রসেসে শুনি, আগে শুনতাম পুরো ধর্মীয় ভক্তিতে। তিনি আমার গুরু। খুলনা ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটিতে ভাইয়া কম্পিউটার নিয়ে যেত। সে কারণেই কপাল খুলতো আমার। সময় কাটত গেম খেলে, সিনেমꦏা দেখে, ভিডিও দেখায়। শুরুর দিকে উইন্যাম্পে গান শোনা ছাড়া আর কিছু পারতাম না। তার আগে অঞ্জন দত্তের গান শুনেছি অন্যের কণ্ঠে। এখনও মনে আছে, প্রথম যেদিন শুনলাম, ‘মন আমার’। আহা কী গান। তখনও বুঝিনি গানটা কবীর সুমনকে ডেডিকেট করা। আমি ধরে নিয়েছি এটা কোনো গানের গুরুকে নিয়ে গান। তারপর আমি ডেইলি অঞ্জন দত্তের একটা গান আবিষ্কারের মতো শুনতাম। সেটাই টানা সারা দিন।
আগে অঞ্জন দত্তের আশি ভাগ গানই মুখস্থ ছিল। তখন যে শুধু অঞ্জন শুনছি তা না, ওয়ারফেইজ, বাচ্চু, এ আর রেহমান বা রবীন্দ্রসংগীত মিলিয়ে এক অদ্ভুত গান শোনা আমাদের। তখন🌸 বড় ভাইরাও ছিলেন খুব প্রভোকিং। যেমন আমার সমরেশের বই পড়া হয়েছিল এক ভাইয়ের কারণে। তিনি আমাকে ভাবতেন জ্ঞানী লোক, আমরা কেন শিবরাম, হুমায়ুন, তারাপদ রায় পড়ে সময় নষ্ট করছি। আমাদের পড়া উচিত সমরেশ। সেই ক্লাস নাইনেই আমি সমরেশের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলি। তখন আমাদের সবার ছিল ব্যক্তিগত লাইব্রেরি করার নেশা।
পিসিতে অঞ্জনের গান বেজে চলছে আর আমি পড়ছি। কৈশোরে আড্ডা আনন্দের বাইরে এসবই আমার বলার মতো জায়গা। আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। আমার মাথায় গেঁথে গেছে এলভিস প্রিসলি, বব ডিলান, দাস কেবিন, বেনিয়াপুকুর লেন, রিপন স্ট্রিট, এন্ট্রালির মোড়, নিউমার্কেট এসব। সেদিন এক ভাইকেও জিজ্ঞেস করলাম, রিপন স্ট্রিট কেমন? কৈশোরে তো আর মোটিভেশনাল স্পিকার 🦩ছিল না, সময়ও ছিল প্রতিকূল। অঞ্জন দত্তই বলে গেছেন, দুপুর বলছে কান্না পেলে ছাদে উঠে গিয়ে সবাই যা বলছে ভুলে যা।
অঞ্জন দত্তের গান শুনলে মনে হবে, সহজ কথা, এরকম তো আমিও লিখতে পারি। আপনি পারেন না, পারবেনও না। পারলেও অঞ্জনের মতো গাইতে পারবেন না। আসিফ যখন গান গেয়ে হিট, তখন অনেকেই আসিফের মতো গান গাইতো। কেউ থাকে নাই রেলিভ্যান্ট। একমাত্র আসিফ বাংলাদেশের ꦑজেলায় জেলায় জনপ্রিয় শিল্পী হিসাবে টিকে আছেন। সেরকম অঞ্জনের মতো হওয়ার অনেকেই চেষ্টা করেছেন। অঞ্জন দত্তই থেকে গেছেন।
অঞ্জন দত্তকে নিয়ে এক ইউটুবারের ভিডিও দেখেছিলাম। তিনি দার্জিলিং গেছেন, সেখানে দত্তবাবুকে কজন নেনে। সেই ভদ্রলোক বাংলাদেশে এসে কন্টেন্ট বানাতে পারেন, যে অঞ্জন দত্তের উসিলায় বাংলাদেশের কতো হাজার জন দার্জিলিং চিনেছে। অঞ্জন দত্ত হলো আমাদের কৈশোর জানালা। জাতীয়তাবাদ মস্তিষ্কের প্রোথিত হব♊ার উর্বর সময়েও আমরা শুনেছি, ‘আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়’ কিংবা ‘এসব সবই তোমার সকাল বেলার খিদে।’
কেউ বলে না অঞ্জন দত্তের ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামটা নিয়ে। পশ্চিম বাংলার কোনো শিল্পীর শ্রেষ্ঠ অ্যালবাম এ দেশে প্রডিউসিং করা। সেটার ভেতরে কি অদ্ভুত সব গান আছে, “নীলা তুমি ছলছল চোখে কেন কলতলাতে’ কিংবা ‘একজন লাকী আকন্দ’। অথবা ছাদের গানের সেই বিখ্যাত স্টেটমেন্ট, ‘এটা ত্রিশ বছর আগের কথা, ত্রিশ বছর আগের কবিতা/হলদে হয়ে হারিয়ে গেছে পাড়ার কোনো চিলেকোঠায়।’ তার𓂃 আগেই তিনি করে ফেলেছেন নিমা রহ๊মানের সঙ্গে গান ও কথা মালার কালজয়ী অ্যালবামটা। সেদিন এক আর্লি টুয়েন্টিজের ছেলেকে দেখলাম এটা শুনছে।
এই যে অঞ্জন দত্তের লুপ, এটা কাটানো বড় মুশকিল। আমার ঢাকায় এসে মোটামুটি কবীর সুমন, নচিকেতা, শিলাজিত, আর্টসেল, আধুনিক বাংলা গান লেগেছে অঞ্জনের লুপ কাটাতে। এখন ওনার কম শোনা গানগুলোই শুনি শুধু। সেখানে অঞ্জন দত্ত গান, ‘তাই পারছি না বুঝিয়ে দিতে কেন গলায় দড়ি দিলো চৌদ্দ বছরের টুকটুকি’ কিংবা ‘গোবিন্🌌দকে মেরেছে তার মালিক গোবিন্দ কাঁদছে রাস্তায়’, ‘একটা দিন ছিল একটা দিন’ অথবা ‘ভগবান জানে এটা শুধু গান নয়’।
আমার গান গাওয়া হতো বাসাতেই, সেখানে শুনতেন শুধু মামা। মামা বলতেন, ‘তোমার গলায় খালি অঞ্জন সুমনই মানায়। ছোটবেলায় গাইতা বাচ্চু জেমসের গান, মানাতো না।’ আর মানা মানি, দুনিয়ার সঙ্গে না মেনে সেই মামাটাই চলে গেলেন এক দুপুরে। মামার দাফনের পরের দিন জামালপুরে বিস্তর কুয়াশা। ঘুম আসে না শোকে, ভোরের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। বের হয়ে গ্রামীণ নির্জনতায় অঞ্জন দত্তের গানই ভরসা, ‘দেখা হবে আবার জেনো কুয়াশায়, কুউউউউ কুয়াশায়’ কিংবা ‘নিয়ে যা নিয়ে যা, ভাসিয়ে নিয়ে যা আমায়’, আর ‘তবু থাকবো তোমার সাথে আমি যেদিন/ থাকবে শুধু🌊ই অন্ধকার।’
আমাদের জীবনে এসব অভিজ্ঞতা ছাড়া আর আছেইবা কী। অঞ্জন দত্ত নিজেও জানেন তার চলচ্চিত্র, অভিনয় জীবন, সাংবাদিক জীবন, মঞ্চ জীবন কিছুই থাকবে না। থাকব🍨ে শুধু গান গুলো। সেদিন এক বাচ্চাদের স্কুল প্রোগ্রামে দেখি ওনার গান গাইছে সবাই মিলে। কী আনন্দ। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে হয়, প্রজন্মের বন্ধন। অঞ্জন দত্তকে তাই জন্মদিনে একটাই অনুরোধ, “গানওয়ালা ও গানওয়ালা, গান থামিও না...”