পাঠাগারের খোঁজে—১০

নানা সমস্যায় ধুঁকছে শিক্ষানগরীর গণগ্রন্থাগার

এম এম মামুন, রাজশাহী প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২২, ০৮:১৮ এএম

রোগী বহনকারী গাড়ির বহর ও দোকানপাটের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার কমপ্লেক্সের প্রবেশপথ। রাজশাহী শিক্ষানগরীর চাহিদা পূরণ করতে পারছে না এখানকার বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার। এর উন্নয়নে প্রকল্প আছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। তবে লাইব্রেরির জমি দখলের হুমকি ঠিকই আছে। পদ আছে, কিন✨্তু প্রায় অর্ধেকই শূন্য। ফলে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমমানের প্রতিষ্ঠান হলেও এর প্রতি কিছুটা অবহেলার প্রমাণই মেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে।

শিক্ষানগরী হওয়ার সুবাদে রাজশাহীতে প্রতিদিন হাজার হাজার পাঠক ও শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ পছন্দ ও প্রয়োজনের গ্রন্থ ও সাময়িকী অনুসন্ধান করে থাকেন। অনেক চাকরিপ্রার্থী তার উপযোগী পাঠ-পঠন সাဣমগ্রী খুঁজে ফেরেন। রাজশাহীতে আরও কিছু লাইব্রেরি থাকলেও সেগুলো নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণ শ্রেণির অসংখ্য পাঠক-গবেষক ও শিক্ষার্থীর জন্য রাজশাহী বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার হচ্ছে উন্মুক্ত ও তাদের উপযোগী প্রতিষ্ঠান। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনেকেরই আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু সীমিত ও সীমাবদ্ধ ব্যবস্থার কারণে তা প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয় না। তা ছাড়া এটি রাজশাহীর সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, সাংবাদিকতা ও ইতিহাসচর্চার কেন্দ্র হিসেবে একটি বৃহৎ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু চার দশকেও তা হয়ে ওঠেনি অজ্ঞাত কারণে। ১৯৮৩ সালে প্রথম দিকে পাঠকের জন্য  ৯৯ হাজার ১৩৮টি বই আসে। এর মধ্যে ১০-১২ হাজার বই নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে বিভিন্ন সমস্যার কারণে দিন দিন পাঠের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আগের চেয়ে বর্তমানে শতকরা ২০-৩০ ভাগ পাঠক কমছে। পাঠক কমে যাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন অনলাইনেই সব তথ্য পাওয়া যায়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সময় কাটানোর কারণে গণগ্রন্থাগারে কমেছে পাঠক। তবে গণগ্রন্থাগারে পাঠক ফিরিয়ে আনতে নতুন নতুন বই ও বিভিন্ন উদ্যোগে প্রয়োজন বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ।

বর্তমান সুবিধাসমূহ

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৮০-৮১ সালে গৃহীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত বিভাগীয় শহর রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরের মেডিকেল কলেজ রোডে ৩ একর ৮০ শতক জমির ওপর এই গ্রন্থাগার স্🎐থাপন করা হয়। ১৬ হাজার ৭২০ বর্গফুট আয়তনের একতলাবিশিষ্ট মূল লাইব্রেরি কমপ্লেক্সে রয়েছে প্রায় এক লাখ বই, সাময়িকী ও সংবাদপত্রের সমাহার, ১০০ বুকশেলফ, সাধারণ পাঠকক্ষ, শিশু-কিশোর পাঠকক্ষ, পুস্তক প্রক্রিয়াকরণ শাখা, প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগ, স্টোর, নামাজঘর প্রভৃতি। অন্যান্য সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, ফি ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই সেবা, ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রভৃতি।

এখানকার 💞সাধারণ পাঠকক্ষ থেকে একদিকে যেমন উচ্চতর পাঠের পাশাপাশি মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষার পাঠ নিতে পারেন তেমনই গবেষণাকর্ম, সাহিত্যচর্চা ও সাধারণ জ্ঞান অর্জনের জন্যও পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে। সংবাদপত্র, সাময়িকী ও রেফারেন্স গ্রন্থ থেকেও সহায়তা পেয়ে থাকেন গবেষকরা। এসব ব্ඣযবস্থা থাকলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের।

২৮ পদের ১৬টিই শূন্য

এখানে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী মোট পদের সংখ্যা ২৮টি। কিন্তু পদ শূন্যই রয়েছে ১৬টি। বর্তমানে একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে ১২ জন কর্মী দিয়ে দিয়ে পুরো লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে। আর শূন্য থেকে যাওয়া পদের মধ্যে রয়েছে, ১ জন পরিচালক, ১ জন সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান, ১ জন সহকারী প্রোগ্রামার, ১ জন কম্পিউটার অপারেটর, ১ জন পাঠকক্ষ সহকারী, ১ জন হিসাবরক্ষক, ১ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ১ 🤡জন বুক সর্টার, ১ জন ইলেকট্রিশিয়ান, ২ জন অফিস সহায়ক, ১ জন বাইন্ডার, ১ জন চেকপোস্ট এটেন্ডেন্ট এবং ৩ জন নিরাপত্তা প্রহরী। এসব পদ শূন্য থাকায় এক শাখার কর্মীকে অন্য শাখায় এবং একজনকে একাধিক কাজে নিয়োজিত রাখতে হয়। এ ছাড়া বিভাগীয় অফিস হওয়ার কারণে এখান থেকে আরও ৭টি জেলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হয় একই জনবল দ💟িয়ে। ফলে কোনো শাখার কাজই সুষ্ঠুভাবে চালানো যায় না।

সমস্যায় ভরপুর

বিভাগীয় এই শিক্ষাকেন্দ্রটির সমস্যার যেন অন্ত নেই। বিভিন্ন সময়ে মূল সড়কটি উঁচু হতে থাকলেও শুরুতে গ্রন্থাগার কমপ্লেক্সটি সে পরিকল্পনামাফিক নির্মাণ না করায় এখন অনেক নিচুতে পড়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই এর সম্মুখ চত্বরে পানি জমে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থেকে পরিবেশ বিপন্ন করে। বৃষ্টির ফলে মূল ভবনের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। এতে পুরু দেয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে। এতে বইপত্রের ক্ষতিসাধন হয়। পুরো কমপ্লেক্স থেকে পানি নিষ্কাশনের যথেষ্ট আউটলেট নেই। নালা-নর্দমাগুলোও নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবে এর সম্মুখ ও পেছন চত্বর জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে থাকে প্রায়ই। বৃহদাকার এই গ্রন্থাগারে নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট। নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় সময়ে অসময়ে অস্বস্তিতে থাকতে হয় এখানকারꦉ জনবলকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে এর সীমানাপ্রাচীরও উঁচু করা জরুরি।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এককেন্দ্রিক মন মানসিকতার কারণে বইপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে বই আসে গতানুগতিক। তা ছাড়া আধুনিক চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী উপকরণ ও জনবল সরবরাহ না থাকায় ꦇতথ্য-প্রযুক্তিসংবলিত তথ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় না। দুর্লভ গ্রন্থ ও রেকর্ডসমূহে সংরক্ষণে যথেষ্ট ব্যব⛄স্থা রাখা হয়নি।

পরিকল্পনা আছে বাস্তবায়ন নেই

এই গ্রন্থাগারের জন্য পরিকল্পনা আছে কিন্তু নেই তার বাস্তবায়ন। এর জ🥀ন্য যেসব পরিকল্পনা রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৫০০ আসনের একটি মিলনায়ত𒐪ন, ১৫০ আসনের একটি সেমিনার কক্ষ ও ৩০ আসনের একটি সভা কক্ষ নির্মাণ, সাধারণ পাঠকক্ষ ১৫০ আসনে উন্নীত করা, ১০০ আসনের বিজ্ঞান পাঠকক্ষ রাখা, ৫০ আসনের রেফারেন্স পাঠকক্ষ করা, নারীদের জন্য ৫০ আসনের পৃথক ব্যবস্থা করা, প্রতিবন্ধীদের জন্য ৫০ আসনের পৃথক ব্যবস্থা রাখা, ২০ আসনের কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, ৫০ আসনের একটি ক্যাফেটেরিয়া, ২০ থেকে ২৫ জন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য একটি ডরমেটরি স্থাপন করা, পরিচালক এবং কেয়াটেকার, নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রভৃতির জন্য গ্রন্থাগার কমপ্লেক্সেই আবাসিকতার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। এই সঙ্গে নিজস্ব জেনারেটর ও সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকার কথা। এই কমপ্লেক্সে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান সংকুলান করা যাবে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ না হওয়ার ফলে এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

ভূমি রক্ষা ও নিরাপত্তা

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবত গ্রন্থাগারের নামে ভূমির নামজারি হয়নি। ১ নং খতিয়ানভুক্ত জমি ছাড়া বাকি জমি গ্রন্থাগারের নামে প্🥂রতীকী মূল্যে বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসকের অফিসে ফাইল চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। গ্রন্থাগারের পূর্ব-দক্ষিণ পাশের কিছু জমি সরকারের আরেকটি বিভাগ দখলে নেওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায় বলে সূত্রে জানা যায়। কিন্তু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের দৃঢ়তার ♕কারণে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। প্রতিষ্ঠানের নামে জমির রেকর্ড সম্পন্ন হলে সে সমস্যা দূর হবে।

অপর দিকে এই গ্রন্থাগারের অবস্থান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সুবৃহৎ স্থাপনার সংলগ্ন। হাসপাতাল একটি স্পর্শকাতর, সর্বদা ব্যস্ততম এবং জনবহুল প্রতিষ্ঠান হওয়ার ফলে এর প্রভাব পড়ে গ্রন্থাগারের ওপরে। এর পুরো প্রাচীরজুড়ে এমনকি প্রধান গেট দখল করে দোকানঘর, অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস প্রভৃতি যানবাহন রাখা হয়। গ্রন্থাগারের প্রাচীরজুড়ে বিভিন্ন খাদ্য ও পথ্যের দোকান জমজমাট থাকে রাতদিন। এতে গ্রন্থাগারের নিরিবিলি পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। সরকার, সিটি করপোরেশন ও হাসপাতালের উদ্যোগে নিকটস্থ একটি স্থান নির্ধারণ করে মধ্যম আয়ের লোকদের উপযোগী একটি মার্কেট তৈরি, অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাসের জন্য একটি গ্যারেজের ব্যবস্থা এবং একটি পু𝓰লিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হলে পুরো স্থানজুড়ে শৃঙ্খলা প𓂃্রতিষ্ঠা হতে পারে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

এসব বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক মো. মাসুদ রান💧া জানান, সমস্যাগুলো সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষক🧸ে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। পরিকল্পনা ও প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে। শূন্য পদসমূহ পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় নিরাপত্তা ও ভূমি রক্ষার বিষয়ে সিটি মেয়র মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে।