মানুষ একা। সত্যিই একা। জীবনের শুরুতে, শেষেও। অন্ধকার নিবাসেও সঙ্গী নেই কেℱউ তার। কেবল মাঝের কিছুটা সময়, কিছু মুখ চেনা হয়ে ওঠে। বাবা-মা, সহোদর, সহোদরা, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু তার🐈া। এ সবই স্বার্থ-সম্পর্ক। কারো মায়ার স্বার্থ, কারো অর্থের। যতক্ষণ আছে, ততক্ষণই। তারপর বুদ্বুদের মতো উবে যায়।
আবু মহসিন খান, ব্যবসায়ী। এখন অবশ্য অবসরে। স্বজন-পরিজন, ছিল সবই। কিন্তু ব্যবসার মতো একসময় তারাও আর ছিল না পাশে। তিনি একা ছিলেন। একা থাকাই বাস্তবতা। কিন্তু মানতে পারেননি একাকিত্ব। কার্যত নিঃসঙ্গ সে জীবন ছিল অনাহু💮ত। বেদনার সহোদর হয়ে বেঁচে ছিলেন যেন।নিরস্ত করতে পারেননি দুঃখকে, নিঃসঙ্গতাকে। তাই বেছে নিলেন মৃত্যুর মতো অনিবার্য একাকিত্বকে। আমরা যাকে বলি, আত্মহনন।
মহসিন খান, আমাদেরই সমাজের চিত্র। এই সমাজের একজন ছিলেন বহুজনের মাঝে। শহরের শক্ত ইমারতের ভেতর ভঙ্গুর হৃদয়ের অধিবাসী। ন🦄েহায়েতই কম নয়। শিথানের পাশেই ঘুমানো মা কিংবা বাবা, অন্তরে নিঃসঙ্গ এক মানুষ। আবার দূর পরবাসে সন্তান, সেও তো একা। যৌথ জীবনেও থাকে একাকিত্বের অন্𝓰তর্দাহ। কজন দেখে সে পোড়া? কজনই জানতে পারে?
পরমাণুর মতো ভেঙে যাচ্ছে সমাজ, পরিবার, সম্পর্ক। নতুন বলয় গড়তে।পরমাণুর মতোই যার স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। অথচ বাইরে থেকে মনে হবে, কতই না সুখে আছে! বিত্ত মানুষেকে সুখ দেয়? কতটা? বিত্ত মানুষকে অসুখী করে? তাই-বা কতটা? একটি গ্লাসের কথা যদি বলি, তাতে একগ্লাস জলই ঠাঁই🍌 পায়। তার বেশি নয়। বেশি হলে উপচে পড়ে, অপচয় হয়, সিক♏্ত করে চারপাশ। উপচে পড়া জলকে যদি বলি অশ্রু? যদি বলি বেদনার দাগ? বরং যতটুকু ঠাঁই হয় ভেতরে, ততটুকু জলের বিত্তই সুন্দর। জীবনকে একটা গ্লাস কি বলা যায়? কম নয়, আবার বেশিও নয়, বিত্ত, মর্যাদা, সম্মান, স্বীকৃতি, তা-ই সুন্দর নয় কি?
মহসিন খানের কথায় যতটু✃কু উঠে এলো, তাতে পারছিলেন না তিনি আর। একে তো কর্কট রো༒গ, অন্যদিকে একাকিত্বের যন্ত্রণা। দেহ আর মন দুটোই ছিল তার ভারাক্রান্ত। অনেক করেছেন যাদের জন্য, তারা এতটুকু বিনিময় রাখেনি তার জন্য। এমনকি বাবাও। নিজের জন্য কিনেছেন কবরের মাটি। আপত্তি তাতেও, সেখানেও যেন না হয় তার শেষশয্যা। কতটা হতাশ ছিলেন নিজের জীবন নিয়ে, বোঝাই যায়।
যৌবনে যে পরিবার-পরিজনের জন্য উদয়াস্ত নোনা ঝরিয়েছেন, তারা আজ যে যার মতো আছে। মহসিন খানের খবর কে রাখে! শঙ্কা ছিল, ছিল আক্ষেপও, যদি একা ঘরে নির্জনে পড়ে থাকেন মরে, তবে? ♑গৃহস্থ ইঁদুর আর আরশোলার শোক ছাড়া কেউ থাকবে না অন্তিম সময়ে। তিলে তিলে এই ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আচমকাই হারিয়ে গেলেন।
মহসিন খান, এই সমাজের প্রতীক๊। উচ্চবিত্তে, মধ্যবিত্তে, কখনো পথের ধারে ঝুপড়িতে সিঁধিয়ে থাকা কোনো একা জীবনের মতো। শক্ত ইমরাত যেখানে ভারি হয়ে উঠেছে দীর্ঘশ্বাসে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর অভিজাত পাড়ায় ঘুরলে প্রায়ই চোখে পড়ে, মলিন, অর্ধমলিন দালান। বোঝা যায়, একসময় প্রাণের চাঞ্চল্য ছিল এখানে। এখন নেই। তাই বলে নির্জনও নয় একেবারে। খোঁজ নিলে জানা যায়, সন্তর্পণে সেখানে ধুঁকছে কোনো প্রৌঢ় প্রাণ। সন্তানরা সব আখের গুছিয়েছেন বিভুঁইয়ে। বৃদ্ধ বাবা বা বৃদ্ধা মা হয়তো অপাঙ্ক্তেয় সে জীবনে। নতুন জীবন যেখানে ক্ষয় হয়েছে সেই মাটির মায়া ভুলতে পারেননি তারা।তাই অগত্যা নিঃসঙ্গতা।এমন উদাহরণ কি কম?
আমরা উন্নত হচ্ছি, অর্থে-বিত্তে-জ্ঞানে-সমাজে-রাষ্ট্রে। কিন্তু আদতে কি হচ্ছে কিছু? সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, বন্ধন কি টুটে যাচ্ছে না ঠুনকো বিলাসে? জীবনের সব বেলা কি একই যায়? 🍌এখন যারা উদিত সূর্যের আলোয় উচ্ছ্বসিত, তাদের জীবনে কি আসবে না আঁধার? মহসিন খানের শূন্য বিছানা, চেয়ার-টেবিল কিংবা বর্গফুটের আয়তনে নতুন বাসিন্দা কি কেউ হবেন না? বার্ধক্য কি স্পর্শ করবে না তাদের? আছে তো তাদের কাছে, একটা লাইসেন্স করা পিস্তল?
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক