পুরোনো পথেই কি নতুন বাজেট

রাজেকুজ্জামান রতন প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৪, ০৪:১২ পিএম

স্বল্প আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা, বিশাল বেকার বাহিনী, মানহীন শিক্ষা, দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষক ও প্রকৃতি নির্ভর কৃষি, দেশে কাজ না পেয়ে যুবকদের বিদেশে যাওয়ার হিড়িক, এই 🗹রকম অবস্থার একটা দেশে বাজেটে প্রাধান্য পাবে কোন কোন খাত, তা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক থাকার কথা নয়।

শোনা যাচ্ছে এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। বাজেট একটি আয়ব্যয়ের দলিল; আর রাজনৈতিক নির্দেশনার প্রতিফলন। সংসদে আলোচনা হওয়ার কথা গত বাজেট বাস্তবায়নে দুর্বলতা কী ছিল এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্য কী 🎀হবে? কিন্তু তা হয় না। ৫২ বছর ধরে দেশের বাজেটের আয়তন ও আকৃতি বেড়েছে প্রতি বছরে। কিন্তু প্রকৃতি একই রকম আছে। তাই প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় বাজেট বড় হয়, ট্যাক্সের বোঝা বাড়ে, ধনীদের সম্পদ বাড়ে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাড়ে, আমলা প্রশাসন খাতে বরাদ্দ বাড়ে। আর সবশেষে এসবের প্রভাবে বাড়ে দ্রব্যমূল্য। সাধারণ মানুষ ভাবে, নতুন বাজেট মানে বাড়তি চাপ, সংসারের খরচ বৃদ্ধি। এই বাস্তবতায় একটু দেখে নেওয়া যাক, যে বছরটা পার করলাম আমরা, সে বছরের বাজেটের প্রতিশ্রুতি কী ছিল?

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল তার ন💎াম ছিল, ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। বাংলাদেশের ৫২তম বাজেটের মূল দর্শন ছিল, ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট🦩 বাংলাদেশ বিনির্মাণ। বলা হয়েছিল, স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট অর্থনীতি—এ চার মূল স্তম্ভের ওপর।

অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, “স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। স্মার্ট বাংলাদেশে তিন শতাংশের কম মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে থাকবে; আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে এবং বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে এবং বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। স্মার্ট বাংলাদেশে শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে সবার দোরগোড়ায়। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা হাতের নাগালে থাকবে। এ ছাড়া তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস🅘 সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।

এই বক্তব্যের কারণে আশা করা হয়েছিল করোনা, বিশ্ব অর্থনীতির বিবেচনায় স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু সে বাজেটে নির্বাচনী চমক হিসেবে বড় মাপের ব্যবসায়ীদের খুশি করতে পুরনো পথেই হেঁটেছিল সরকার। বড় ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের ‘কর ছাড়’ দিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে রাজস্ব জাল বিছিয়ে সাধারণ আয়ের মানুষকে আটকে ফেলা হয়েছিল। বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ অর্থবছরের জন্য আয় হিসাব করা হয়েছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখꦓ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সরকারের আয় বৃদ্ধির প্রধান উৎস এনবিআর। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। বাজেটে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের পদক্ষেপ ছিল। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রণয়ন করার কথা൲ ছিল জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সময়ভিত্তিক সূত্র। তার বাস্তবায়ন যথাযথভাবেই হয়েছে। ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে করের ওপর সারচার্জ দিতে হতো, সেই সীমা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছিল। একদিকে নির্বাচনী বছর, আরেকদিকে অর্থনীতিতে নানা সংকট; তাই বাজেটে ছোটদের কর পরিশোধের জন্য চেপে ধরলেও কৌশলে বড় ব্যবসায়ীদের ঠিকই খুশি রাখা হয়েছিল। ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আর কমেনি।

সাধারণ আয়ের মানুষের আয় বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের খরচ অনেক বেড়েছে। বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা সবকিছুই দুই ডিজিটের ওপর বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধু ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি কমাতে সরকারের পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তাই বাজারের আগুনে ঝলসে গেছে সাধারণ মানুষের চামড়া। বেশি দামে বিক্রি হয়েছে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, লবণ, চিনি, মাছ, মাংসসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য। কমেনি চিকিৎসা, যাতায়াত, শিক্ষাসহ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ও। বড় ব্যবসায়ীদের খুশি করা ও খুশি রাখার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক ছিল না। অনেক কথা বলা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কাছে সমর্পণ করা হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করা, আয়বৈষম্য রোধ করা এবং রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা ছিল গত বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ জীবন দিয়ে বুঝেছেন।

এবার꧋ের বাজেট কেমন হবে, তার যতটুকু আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে বলা যায়, নানা চাপের মধ্যেও ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এর মধ্যে কর আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থ বছরে রাজꦗস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ফলে রাজস্ব আহরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে আগামী বাজেটে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হবে অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। যার আকার ধারণা করা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ ജশতাংশ বেশি এই বাজেট টাকার অঙ্কে বাড়বে ৩৫ হাজার ১১৫ꦉ কোটি। ঘাটতিও বাড়বে, ঘাটতি হবে অনুদানসহ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হবে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি পূরণে ঋণ করবে সরকার। প্রাথমিকভাবে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি নেওয়া হবে ব্যাংক থেকে। আর সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে (১১৭০ কোটি মার্কিন ডলার) বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হবে। ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ দিতে হবে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।

এবারের বাজেটের টার্গেট কী, তা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি নিত্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং জীবনযাত্রার⛦ মান যেন সীমার মধ্যে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হবে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকারে রাখা হয়েছে।

গত বাজেটেও এমন কথাই শুনেছিল দেশের মানুষ। কিন্তু বাস্তবে দেখেনি। তবে এবার উপায় হিসেবে বলছেন যে, ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন করা, পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, আর সরবরাহ স্🅰বাভাবিক রাখার ফলে পর্যায়ক্রমে কমে আসবে মূল্যস্ফীতি। এটা করা উচিত; কিন্তু করা যায় না কেন, এই প্রশ্ন তো মানুষের। কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে উঠেছে বলে বিআইডিএসের গবেষণায় দেখানো হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য গড় মূল🍒্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হবে। প্রাক্কলিত এবং বাস্তবের মধ্যে ফারাক দেখে অভ্যস্ত মানুষ কি ভরসা পাবে এই কথায়?

অর্থ বিভাগের ধারণা, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমছে। ফলে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। তারা বলেছেন, সরকারি ব্যয়েও কৃচ্ছ্র সাধন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে জনগণ🤪 দেখছে ২৬১ উপজেলায় এসইউভি গাড়ি কেনা হচ্ছে। সরকার আশা করছে, আগামী দিনে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে এবং পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে। এইসব পদক্ষেপ কি এতদিন নেওয়া হয়নি, ফলাফল কী?

সাধারণভাবে এটা তো সত্য যে, মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্য ও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক 🅘ব্যবস্থাপনার ওপর। বিগত দুবছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ফলে সে সময় দেশেও দাম বেড়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা হিসেবে মেলে না যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, অভিজ্ꦡঞতা এই যুক্তিকে সমর্থন করে না।

এবারের বাজেটে নাকি মূল্যস্ফীতি ছাড়াও ‘সবার জন্য খাদ্য’, পণ্য সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রতিটি গ্রামকে আধুনিকায়নকরণ, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ফাস্ট ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্প গুরুত্ব দেওয়া, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলা এবং বৈশ্ব🏅িক সংকট মোকাবিলায়🦹 পদক্ষেপ গ্রহণ এইসব বিষয়কে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে।

এসব করতেই রাজস্ব আহরণে জোর দেবে সরকার। বড় অঙ্কের র🎶াজস্ব আহরণের জন্য দেশের প্রধান ভ্যাট প্রাপ্তির অঞ্চল ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণ করা হবে। শনাক্ত করা হবে নতুন করদাতা। নতুন করদাতাদের করের জালে আটকাতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন ও ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসবের সামগ্রিক ফল কী দাঁড়াবে? কর বাড়বে, দর বাড়বে আর এর চাপ সহ্য করতে হবে সেই জনগণকেই। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি আর বেকারত্ব দূর করা🌞র আশা এবারও অধরাই থেকে যাবে।

লেখক: শ্রমিক নেতা ও কলাম লেখক