ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত

‘আমি আল্লার কাছে বলে দেবো’

সুজন কবির প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৩, ০৭:১৭ পিএম

আইএস জঙ্গি উত্থানের সময়💮 বোমা হামলায় আহত এক সিরিয় শরনার্থী শিশু মৃত্যুর আগে ফিসফিস করে বলেছিলো ‘আমি আল্লার কাছে বলে দেবো’। শিশুটির শেষ বাক্যটি তখন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। কিন্তু তারও আগে যুগযুগ ধরে একই কথা বলে গেছে গাজা উপত্যকার শিশুরা। ইসরায়েলি গুলি বোমায় ফুলগুলো অকাতরে ঝরে গেছে। মরতে মরতে তারা-তাদের মায়েরা দু’হাত তুলে আল্লার কাছে বিচার দিয়ে গেছে। সে বাক্য আল্লার আরশে পৌঁছেছিলো কিনা জানি না; তবে কথিত সভ্য দুনিয়ার কানে পৌঁছায়নি।  


ইতিহাসের এমন কোন বছর নেই যে বছর ইসারায়েলি গুলি বোমায় ফিলিস্তিনি শিশুরা মরেনি। একেকটা বছর গেছে ফিলিস্তিনিরা ঝাড়েবংশে সাফ হয়েছে। আর বিশ্ববাসী ভেবেছে এমনটা বুঝি এবারই প্রথম। পরেরবার আবারও রক্তাক্ত এই ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের রক্ত ঝরেছে। বিশ্ব আবারও ভেবেছে এমনটা এবার♔ই প্রথম। এভাবে একই চক্রে পাক খেয়ে চলেছে এই উপত্যকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। 


ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ববাসীর এই যে ডিমনেশিয়া, এবার তার একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি স্বশস্ত্র সংগঠন হামাস। এবার এমন এক অধ্যায়ের সূচ🙈না করেছে হামাস, জীবিত ইসরায়েলীরা যাকে কোনদিন ভুলতে পারবে না। এই ইতিহাস তাꦓদের তাড়া করে ফিরবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। 


যে ঘটনা রোজ ইসরায়েল ঘটায় এবার সেই একই ঘটনা ঘটালো হামাস। হামাসের রকেট হামলায় যখন একের পর এক ইসরায়েলি বাড়িঘর উড়ে যাচ্ছিল নারীশিশুরা, তারা যখন প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছিল, তাদের চোখে মুখে যেন ফিলিস্তিনিদের সেই একই আতঙ্ক জায়গা করে নিয়েছিল। হামাসের বন্দুকের নলের সামনে ইসরায়েলি নারী শিশুদ𒁏ের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটা হৃদয় বিদারক। কিন্তু একই দৃশ্য যখন বারবার ফিলিস্তিনিদের বেলায় ফিরে এসেছে তখন ইসরায়েলকে কেউ একবারের জন্যেও থামতে বলেনি। কোথায় থামতে হবে, বর্ণবাদি কট্টর রাজনীতিক নেতানিয়াহুকে সে কথাটি  কেউ মনে করিয়ে দেয়নি। 


গত কয়েকমাসেও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়মিতভাবেই ইসরায়েলি হামলা চলেছে। নিহতদের বড় অংশই ছিল নিরস্ত্র নারী শিশু ও বেসামরিক জনগণ। এসব হামলার মধ্যেই ফিলিস্তিনি সীমানা দখল করে চলছিল নতুন আরও দশহাজার বসতি নির্মাণ। এভাবে নেতানিয়াহু’র দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের শাসনামলে ফিলিস্তিনের মানচিত্রটা শীর্ণ থেকে আরও শীর্ণ হয়েছে। প্রতিবছর ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়ে উঠেছে। দখল করা সেসব ভূমিতে ইসরায়েলি রিসোর্টের সংখ্যা যত বেড়েছে; বিপরীতে গাজা উপত্যকা তত বেশী ঘনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। হতভাগ্য মানুষগুলোর বাঁচা মরা যেন নেহায়েত বর্ণবাদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একদিকে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে নেতা๊হিয়াহুর বহুমুখী আগ্রাসন, অন্যদিকে সৌদীসহ বহির্বিশ্বে তার মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিন প্রসঙ্গের অনুপস্থিতি। যেন বা এ অঞ্চলে ফিলিস্তিন বলে কোন ভূখণ্ডের অস্তিত্বই নেই। সব মিলে কট্টর নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনকে যেন বদ্ধ দেয়ালের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার সেই দেয়াল ভেঙেছে হামাস। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গাজার নিরিহ নিরস্ত্র মানুষের রক্তক্ষয় ছাড়া এতে আর কী লাভ? 


সন্দেহ নেই এবার গাজা ভূখণ্ডকে সেই পঞ্চাশের দশকের উষর প্রান্তরে পরিণত করবে ইসরায়েল। চলবে স্মরণকালের সবচে বর্বর গণহত্যা। গাজা এখন গ্যাস বিদ্যুৎ পানিহীন এক বিধ্বস্ত নগরী। কেবল গুলি বোমায় নয়; এই জনপদকে মানুষের বেঁচে থাকার সকল উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাতে-পানিতে মারার কৌশল নিয়েছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে গাজার একটা ভবনও তারা আস্ত রাখবে না। ইসারায়েল এমনভাবে তার রণকৌশল সাজিয়েছে যাতে আস্তে আস্তে চারদিক থেকে গাজা ভূখণ্ডকে ঘিরে ফেলা যায়। এরপর চালানো হবে চূড়ান্ত হত্যাযজ্ঞ। আর🔥 হামাস বলছে, একেকটা হামলার বিপরীতে একজন করে ইসারয়েলি নাগরিককে হত্যা করা হবে। খবরে বলা হচ্ছে ইসরায়েলের অন্তত দেড়শ নাগরিক হামাসের যুদ্ধবন্দী। এ ছাড়াও বন্দী আছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বহু বিদেশী নাগরিক। নিজ নাগরিকদের প্রাণ রক্ষায় ইসরায়েল হামলার রাশ টানবে বলে মনে হয়না। 


কখন এবং কোথায় থামবে নেতানিয়াহু প্রশাসন সেটি এখনই বলা মুশকিল। কারণ ইসরায়েলের মনোবল বাড়াতে গাজার কাছেই সমুদ্রে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তুর্কি নেতা এরদোয়ান। ইরান আগের মতোই হামাসকে সমর্থন যুগিয়ে 🐠যাচ্ছে। লেবাননের আরেক গেরিলা গোষ্ঠি হিজবুল্লাহর পুরনো শত্রু ইসরায়েল। ইরানের অস্ত্র সহায়তা পায় দলটি। কিনไ্তু হিজবুল্লার সমর্থন হামাসের শক্তিতে বড় কোন সামর্থের যোগান দেবে না। হামাসকে সরাসরি সমর্থন না দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে থাকার কথা বলেছেন সৌদি যুবরাজ সালমান। কদিন আগেও সালমানের সাথে ইসারায়েলের ‘সম্পর্ক সহজীকরণ’ (ফিলিস্তিনকে বাদ রেখেই) সংক্রান্ত আলোচনা চলছিল।  আপাতত সে আলোচনায় বাধা পড়ল ঠিক। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ‘পোড়া মাটি’ হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে কিনা সেটি এখনও বলা যাচ্ছে না। 


এই পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে একমাত্র রাশিয়া। ইসরায়েলের জন্য সব কিছুই কঠিন করে তুলতে পারেন কেবল পুতিন। তাঁর সামনে এখন মধ্যপ্রাচ্যের নাটাই দখলের সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু তাতে আবার বহুপক্ষীয় সংঘাত (বলতে পারেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ) শুরুর ঝুঁকিতে পড়তে পারে বিশ্ব। ইউক্রেনের পর তেমন আরেকটা ঝুঁকি পুতিন নেবেন কিনা সেটাও বড় প্রশ্ন।  
সব মিলে এক অসম্ভব লড়াইয়ে নেমেছে 🅰হামাস। আজ হোক কাল হোক, হামাসের জন্য এ লড়াই অনিবার্য ছিল। এ যুদ্ধে এবার গাজার ২৩ লাখ মানুষের অর্ধেকও যদি শহীদ হয়; বিনিম💧য়ে স্বাধীনতা না হোক; অন্তত ফিলিস্তিন যে কোন ভুলে যাওয়া নাম নয়; বিশ্বের কাছে সেটিও যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে হামাস সেটাই তার জয়। ইতিহাস বলে: ফিলিস্তিন হলো সেই জাতিরাষ্ট্র ( স্বীকৃতি না পেলেও), যারা জানে কী করে ধংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।

 

লেখক: সাংবাদিক