চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের কয়েক মাসের হালনাগাদ প্রতিবেদন রাখঢাক ছাড়া প্রকাশ হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। নামে-বেনামে নেওয়া✃ এসব ঋণ আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। তবে পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার খোঁজখবর রাখা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সর্বোচ্চ মুনাফায় বিশ্বাসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধনিক গোষ্ঠীর ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা সত্যিকার অর্থে কখনোই আর ব্যাংকে ফিরে আসে না। হুমকি-ধামকি-চাপ-তাপ কিছুই স্বেচ্ছায় ঋণ খেলাপিদের নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা, আরও বেশি ঋণ নেওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। এর প্রমাণ, বাংলাদেশের চার দশকের ঋণ সংস্কৃতি।
বাংলাদেশে এখন ব্যাংক খাতের মোট ঋণের (মোট ঋণ স্থিতি🧸র পরিমাণ ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা) ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ (অবলোপন, পুনঃতফসিল ও অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা মামলার টাকা যুক্ত করে হিসাব-নিকাশ নির্মোহভাবে হলে খেলাপি ঋণ অন্তত ৩৫ শতাংশ হবে), যা ঠিক ১ বছর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা বা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০.১১ শতাংশ। অথচ গত ৫ আগস্ট পতন হওয়া সরকার ২০০৯ সালে দেড় দশকের শাসনকাল শুরুর সময় দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা (মোট বিরতণকৃত ঋণের ৮-৯ শতাংশ)। অর্থাৎ পতিত সরকারের ২০০৯-২০২৪ শাসনামলে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। তারও আগে ১৯৯১ সালে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জোরকদমে যাত্রা শুরু সময় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৩-৪ শতাংশ)।
ওপরে উল্লেখ করা তথ্যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও ঋণ খেলাপির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ও বোঝাপড়া ꦡউপলব🌱্ধি করা নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়। এ জন্যেই বলা হয়, পুঁজিবাদ এক মূল্যবোধহীন অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। দারিদ্র্য দূর করা তার লক্ষ্য নয়। প্রেরণাটা যদি হয় আর্থিক স্বার্থ, তাহলে ঋণ খেলাপিদের লজ্জা কি করে হবে।
বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের অভিশাপ ও দুর্বৃত্ততাড়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্পর্ক বিশ্লেষণের আগে বলে নেওয়া ভালো যে বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা মূলত ব্যাংকনির্ভর। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন নাকি, সরকারের অধীন তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থমন্ত্রীর অধীনে চাকরি করেন, গভর্নর-ডেপুটি গভর্নররা নিয়োগ পান বড় বড় লুটেরাদের তদবির-লবিংয়ে—এমন ধারণা সর্বত্র। আবার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিকিউরিটিজ মার্কেট বা শেয়ারবাজারের ভূমিকা নগণ্য, তা-ও আবার তা পুঁজিপতি-রাজনীতিবিদ-আমলা লুটেরাদের দখলে। লুটপাট সহজ করতে এমন এক অ𓂃বস্থায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের প্রকৃত মূল্য যে আদৌ আর ব্যাংকে ফিরবে যাবে না, তা হলপ করেই বলা যায়। বিষয়টি সহজে ব্যাখ্যা করা যায় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের কিছু মূল্যায়ন থেকে। যেমন ১৯৯০ সাল পরবর্তী প্রায় চার দশকে বাংলাদেশে স্বজনতুষ্টিবাদী-আগ্রাসী-চৌর্যতান্ত্রিক-রেন্ট সিকিং গোষ্ঠীর (ফাও খাওয়া হাতেগোনা লোকজনের সমষ্টি) যেভাবে উত্থান হয়েছে, তা এখনো অপ্রতিরোধ্য গতিতেই এগিয়ে চলছে। এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করছি, যা রাতারাতি বদলে ফেলা শুধু অসম্ভবই নয়, দুঃসাধ্যও বটে। কারণ শাসক-শোষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফাও খাওয়া লোকজনের রেন্ট-সিকার গোষ্ঠী সুচারুরূপে সব ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করে ফেলেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ-সম্পত্তি কারো কাছে কম দামে বিক্রি করে তাদেরই উৎপাদিত পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়; সরকারি ক্রয়নীতির আইনকানুন এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে ফাও খাওয়া গোষ্ঠী সুবিধা পায়; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি-গ্যাস-কয়লা ইত্যাদিতে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুবিধা এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়, যাতে লুণ্ঠনমূলক মূল্য নির্ধারণ সহজ হয় যেখানে কোনো কোম্পানি তার প্রতিযোগীদের বাজার থেকে উচ্ছেদে প্রথমে পণ্যের মূল্য কম রাখবে এবং প্রতিযোগীরা উচ্ছেদ হলে পরে ‘আজ বাতাস ওপর দিকে বইছে’ জাতীয় অজুহাত দিয়ে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে বাজারে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরনের কোটা এমনভাবে প্রদান করা হবে, যাতে কর-শুল্কসহ বাজারের বিভিন্ন আইন-কানুন-বিধি-বিধান ফাও খাওয়াদের পক্ষে যায়; ফাও খাওয়ারা যাতে সর্বত্র বাড়তি সুবিধা পায় সে জন্য ব্যাংকিং খাতে প্রকল্প ঋণ থেকে শুরু করে এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমদানি অর্থায়ন), ক্যাশ ক্রেডিট, পিএডি সুবিধা, পুনঃতফসিলীকরণ, ঋণের অবলোপনসহ খেলাপি ঋণসমূহে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম উদ্বুদ্ধ করা হয়, যেখানে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক-আমলাসহ রাজনৈতিক দলসমূহের পাতি নেতাদের নাতি-পুতিরারও সুবিধা পায়; আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং আর রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এমনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, যাতে ঋণ করা অর্থ সহজে বিদেশে পাচার করা যায়; দুর্যোগ এলে বিভিন্ন সেক্টরে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা এমনভাবে প্রদান করা হয়, যাতে ফাও খাওয়ারা আরও সম্পদশালী হয়; কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে কমিশন নামের উচ্চ অংক এমনভাবে ধার্য হয়, যাতে ঘুষ দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়; কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতে ধনীবান্ধব সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনা এমনভাবে দেওয়া হয়, যাতে আর ঋণ ফেরত দিতে না হয়। এসব ছাড়াও বাজেটে ধনীবান্ধব কর-শুল্ক হার নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করা; বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণে অযথা ও অযৌক্তিক মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টি করা; আইন শিথিল করে পণ্যের বেআইনি মজুদ উৎসাহিত করা; পুঁজিবাজারে অস্বচ্ছ ও তথ্য গোপনের খেলা করা; নিয়ন্ত্রক সংস্থা-প্রতিষ্ঠানে তেলবাজ-আলুবাজদের নিয়োগ দেওয়া; গণমাধ্যম ব্যবস্থা কিনে ফেলাসহ হেন অপকর্ম নেই যা করা হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, এসব অপকর্মে দোসর হিসেবে পাশে থাকেন মূলধারার এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদও, যারা উদ্ভট গবেষণা ফলাফল হাজির করে বলেন, ‘ফাও খাওয়াদের সিন্ডিকেট’ আসলে অপ্রমাণিত ও অমূলক এক ধারণা।
বাংলাদেশকে কীভাবে খেলাপি ঋণ নামক অভিশাপ থেকে মুক্ত করা যায়, সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অর্থনীতি শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে এক্ষেত্রে আমারও কিছু মতামত দেওয়া অসম্ভব নয়। তবে সেদিকে না গিয়ে খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের মাথার ঘাম পায়ে পড়ার আগে শুকিয়ে যাওয়া সাধারণ জনগণের জীবনকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ও বিষিয়ে তুলছে, সেদিকে আলোকপাত করা যাক। প্রথমেই আসে ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতার কথা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হলে ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকে না বা পুঁজির ঘাটতি দেখা দেয়, 𓆏যা তাদের স্বাভাবিক ঋণ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ক্ষতিপূরণের জন্য ব্যাংকগুলো সাধারণ গ্রাহকদের ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ নেওয়া কঠিন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন প্রকল্প ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাধা। খেলাপি ঋণ বেশি হলে ব্যাংকগুলো সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বা ব্যক্তিগত ও ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। ফলে অর্থের অভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়ত, জনগণের ট্যাক্সের অপচয়। খেলাপি ঋণ মেটানোর জন্য সরকারকে নিয়মিত হারে জনগণের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপাতে হয় অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট বা পুনঃপুঁজি সরবরাহের জন্য, যা সাধারণ মানুষের অর্থের অপচয় এবং অন্য উন্নয়ন খাতের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। চতুর্থত, খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন, যা অর্থনৈতিক গতি ও প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। পঞ্চমত, সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি। বড় বড় ঋণ খেলাপিদের ক্ষেত্রে ঋণ মওকুফ, পুনঃতফসিল ও অবলোপন করা হলেও সাধারণ ঋণগ্রহীতারা কড়া শর্তে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ পরিশোধের বেড়াজালে পড়েন, যা সমাজে বৈষম্য ও ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে (বিগত সরকারের ঝাড়েবংশ পতন অন্যতম উদাহরণ)। ষষ্ঠত, মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস। খেলাপি ঋণের ফলে আর্থিক বাজারে চাপ তৈরি হয়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, যা জীবনযাত্রার মানে গুরুতর প্রভাব ফেলে (উদাহরণ বাংলাদেশে বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা)।
অনেকের মনে হতে পারে, বাংলাদেশেই কেবল খেলাপি ঋণ হতে দেখা যায়। বিষয়টি ঠিক না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুসরণকারী কমবেশি সব দেশেই খেলাপি ঋণ একটি সমস্যা। তবে বাংলাদেশের মতো খেলাপি ঋণের নষ্ট সংস্কৃতি খুব কম দেশেই আছে। এর মূল কারণ, বাংলাদেশের নদর্মার আবর্জনাসম রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আমলাদের দৌরাত্ম্য। বিদ্যমান এই অবস্থা বহাল থাকলে খেলাপি ঋণ কমা তো দূরে ভবিষ্যতে বিপজ্জনক রূপ নেবে। কারণ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সর্বোত সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। অতিরিক্ত লাভ-লোভের আকাঙ্ক্ষায় অনেকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যা সফল না হলে ঋণ খেলাপি বাড়ে। আবার করপোরেট প্রভাবশালꦺীরা রাজনৈতিক যোগসাজশে বড় অংকের ঋণ গ্রহণ করে, যা পরিশোধ না করে ছলে-বলে-কৌশলে বারবার আরও ঋণ গ্রহণ করে। এই অবস্থা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আছে (তবে সেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের মতো অভিশপ্ত নয়)। দেশটির অর্থনীতি যদিও পুরোপুরি ঋণনির্ভর এবং সেখানে ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও সরকার ঋণ নিয়েই তাদের যাবতীয় কাজকর্ম সারে। এ কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ঋণখেলাপি (খেলাপি হওয়ার আগে ঋণের সিলিং বাড়িয়ে নেয়)। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশꦓটি ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বা নন পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১.৪ শতাংশ। ২০০৮ সালের সাবপ্রাইম মর্টগেজ বা ভয়াবহ মন্দার পর ২০১০ সালের মার্চে দেশটিতে সর্বকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ছিল ৭.৫ শতাংশ। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মন্দার সময় ছিল, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছিল। তারপরও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক স্থিতিশীল ছিল, খেলাপি ঋণের পরিমাণও ছিল খুবই কম (২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৮-৯ শতাংশ)। আর এখন দমিয়ে রাখা হিসাবেই খেলাপি ঋণ প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে বিতরণ করা ঋণের অর্থাৎ ২ লাখ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা ছিল কৃষিখাতে, বাকি টাকার সিংহভাগই ছিল তৈরি পোশাক ও শিল্প খাতে। পরবর্তী দেড় দশকে কৃষিতে ঋণ কেবলই কমেছে, আর শিল্প খাতে বেড়েছে; যা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের যোগসাজশে লোপাট হয়েছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের হিস্যা ছিল ৩২.৭ শতাংশ, যা পরে ক্রমাগত কমেছে বেসরকারি ব্যাংকের দৌরাত্ম্যে। লুটপাট সহজ করতে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি ব্যাংক খোলা হয়েছে, আরও ডজনখানেক ব্যাংক খোলার আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পড়ে আছে। অথচ বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র এশিয়ার ধনী রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর ব্যাংক ৫টি, মালয়েশিয়ায় ৯টি। তারপরও দিন কয়েক আগেই ব্যাংকিং খাত কিনে ফেলা শিল্পপতিদের নেতা গণমাধ্যমের কাছে সগৌরবে বলেছেন, “নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ।” সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
কীভাবে ঋণ না নিয়েও মাথার ওপর চেপে বসা ঋণ (বিদেশি ঋণ) এবং ফাও খাওয়াদের খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করা যায়, তা নিয়ে অর্থনীতি শাস্ত্রে অনেক উপায়-উপকরণ বাতলে দেওয়া আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তত্ত্ব-উপাত্ত দিয়ে এ সমস্যা নিরসন যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন তাই ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর আইন ও এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যোগ্য ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিতে এবং রাজনৈতিক প্রভাব এড়িয়ে চলতে স্বচ্ছ ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ প্রতিরোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমাহার করতে হবে, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা ও ঋণগ্রহীতাদের কার্যক্রমের ওপর নজরদারির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতার মাধ্যমে, রাজনৈতিক পাতি নেতাদের ব্যাংকের প𓄧রিচালনা পর্ষদ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকার ও আমলাদের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে চলার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি