রাজনীতি করাটাই কি অপরাধ?

প্রভাষ আমিন প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩, ০৩:২৪ পিএম

মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ঠিক এক মাস পর জামিন পেলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ওী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এই লেখা পর্যন্ত তারা মুক্তি পাননি। তবে হাইকোর্টের দেওয়া ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখায় তাদের মুক্তি পেতে আর কোনো বাধা নেই। আশা করি, এই লেখা প্রকাশের আগেই মুক্তি পেয়ে যাবেন বিএনপির এই দুই প্রবীণ নেতা। সরকার বাগড়া না দিলে শৈত্যপ্রবাহের আগেই তারা মুক্তি পেতে পারতেন।  

অবশ্য মানুষ অপরাধ করলে কারাগারে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক, এটাই আইনের শাসন। অপরা𓄧ধীর জন্য শীত-গরম, বয়স কমবেশি বিবেচনার সুযোগ নেই। অপরাধ করলে সাজা পেতেই হবে। অপরাধের ধরন বুঝে সাজা কমবেশি হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ৭৪ বছর বয়সী মির💖্জা ফখরুল আর ৭১ বছর বয়সী মির্জা আব্বাস কোন অপরাধে এক মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকলেন? তারা কতটা ভয়ংকর অপরাধী যে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন ঠেকাতে চেম্বার আদালত পর্যন্ত যেতে হলো?

গত ৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে তাদের নিজ নিজ বাসভবন থেকে তুলে নেওয়ার প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর আদালতে হাজির করা হয়। তারপর থেকেই তারা কারাগারে। আমার ধারণা ছিল, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণমমাবেশের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পরই তারা জামিন পেয়ে যাবেন। গণসমাবেশ সীমিত রাখার কৌশল হিসেবেই হয়তো সরকার সমাবেশের আগে ধরপাকড় চালিয়েছে। তার অংশ হিসেবেই হয়তো তুলে নেওয়া হয়েছিল বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে। তখন বলা হয়েছিল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ, তুলে নেওয়ার সময়ও তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট মামলার ওয়ারেন্ট ছিল না। তুলে নেওয়ার পর ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সংঘর্ষের মামলায় আসামি করা হয়। অথচ মামলার এজাহারেও তাদের নাম ছিল না। ১০ ডিসেম্বরের পর তাদের জামিন হয়ে গেলে, এটাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে। কিন্তু নিম্ন আদালতে চারবার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর হাইকোর্ট যখন ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার পরও যখন রাষ্ট্রপক্ষ চেম্বার আদালতে গেলেন, তখন বুঝতেই অসুবিধা হয় না; এটা যতটা বিচারিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
 

সরকার কেন মির্জা ফখরুলকে কারাগারে আটকে রাখতে এত বেপরোয়া, বোঝা মুশকিল। নিম্ন আদালতের জামিন দেয়া না দেয়া অনেক কথা শোনা যায়। তারপরও ধরে নিচ্ছি, তাদের জামিন দেয়ার মত এখতিয়ার নিম্ন আদালতের ছিল না। কিন্তু হাইকোর্ট তো শুনানি করেই তাদের ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন, তা-ও আটকের প্রায় এক মাস পর। হাইকোর্টের জামিন পর্যন্ত বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়াতেই ছিল। কিন্তু মির্জা ফখরুলের জামিন ঠেকাতে চেম্বার জজের কাছে ছুটে যাওয়াটা, এ মামলায় সরকারের পক্ষপাতিত্বকে স্পষ্ট করে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের চেম্বার আদালতের যাওয়ার আইনি এখতিয়ারও আছে। যা হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ায়ই হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ চেম্বার আদালতে না গেলে বিষয়টা রাজনৈতিকভাবে শোভন হতো।  
 

মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তাতে এ মামলায় তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। বিচারপ্রক্রিয়া শেষেই জানা যাবে, আদালতের রায়। তবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ মামলায় তাদের কিছুই হবে না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় গিয়েই হয়তো মামলাটি ডিপফ্রিজে চলে যাবে। সরকার প্রয়োজনমতো ফ্রিজ থেকে বের করবে। এগুলো হলো রাজনৈতিক মামলা। গত এক যুগে এমন শতাধিক মামলা হয়েছে মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে। সারা দেশে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও এ ধরনের মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সরকার ইচ্ছা করলে গ্রেপ্তার করতে পারে, ইচ্ছা করলে জামিন দিতে পারে, ইচ্ছা করলে আটকে রাখতে পারে। যেম༺ন রাষ্ট্রপক্ষ যে মির্জা ফখরুলের জামিন স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজের কাছে গেছে, সেটাও কিন্তু আইনি প্রক্রিয়াই। কিন্তু চাইলেও সরকার মির্জা ফখরুলের মুক্তি দিতে পারত, চেম্বার জজের কাছে না গেলেই হতো। মির্জা ফখরুল বা মির্জা আব্বাস এমন কোনো সন্ত্রাসী নন যে, তারা জামিন পেলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হবে বা তারা পালিয়ে যাবেন বা তারা এমন কোনো বিপ্লবী নেতাও নন যে তারা মুক্তি পেলেই দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়ে যাবে। যে মামলায় মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস কারাগারে, তার চেয়েও অনেক গুরুতর অভিযোগের মামলা তাদের বিরুদ্ধেই আছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেশজুড়ে অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ৮-৯ বছর পরও তার কোনোটিরই বিচার হয়নি। আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার মামলাও রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকে আছে। দাবি জানাচ্ছি, যে বা যারাই এ ঘটনার জন্য দায়ী হোক, তারা যে দলই করুক, অগ্নিসন্ত্রাসের দায়ীদের যেন শাস্তি পায়।

যে ঘটনায় মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস কারাগারে, তা খুব বেশি পুরোনো নয়। আপনাদের সবারই মনে থাকার কথা। ঘটনার সূত্রপাত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে। সরকার তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলেছিল। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সমাবেশ করার ব্যাপারে গো ধরে থাকে। শেষ পর্যন্ত গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে পারলেও তার আগে ৭ ডিসেম্বরেই ঘটে যায় অনেক কিছু। বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে আগে থেকে নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে চলে আসে। আগেভাগে আসা নেতাকর্মীদের খাওয়ানোর জন্য আয়োজন ছিল খিচুড়ির। ৭ ডিসেম্বর বিকালের দিকে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। নেতাকর্মীদের ঢিলের জবাব দেয় পুলিশও। একপর্যায়ে পুলিশ গুলিও ছোড়ে। তাতে একজন মারাও যান। পরে বিএনপির কার্যালয় ঢুকে পুলিশ ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। কার্যালয়ে অবস্থান নেওয়া কয়েক শ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। খিচুড়ি রান্নার উপকরণ নিয়ে যায়। পুলিশ দাবি করেছে, সেখান থেকে তারা ককটেল উদ্ধার করেছে। তবে বিএনপি দাবি করেছে, তাদের কার্যালয়ে ককটেল ছিল না। পুলিশ ব্যাগে করে নিয়ে উদ্ধার দেখিয়েছে। পুলিশ লাথি মেরে মোটরসাইকেল ফেলে দিচ্ছে, এমন ভিডিওও ভাইরাল হয়েছে।
 

মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন। তবে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, এমন কোনো ছবি আমরা দেখিনি। বা তারা কোনো উসকানিমূলক নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেটাও শুনিনি। বরং ৭ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশকেই একটু অতি উৎসাহী মনে হয়েছে। ঘটনা যা-ই ঘটুক, পুলিশ কীভাবে মামলা সাজাবে, কীভাবে তদন্ত করবে, কীভাবে চার্জশিট দেবে, কীভাবে সাক্ষী জোগাড় করবে; তার ওপর নির্ভর করবে বিচারপ্রক্রিয়া। তবে দেখেশুনে মনে হচ্ছে রাজনীতি করাটাই মির্জা ফখরুল আর মির্জা আব্বাসের মূল অপরাধ।
 

ঢাকার একটি অংশে মির্জা আব্বাসের ব্যাপক প্রভাব ছিল। কিন্তু মির্জা ফখরুল বরাবরই ভদ্রলোক। সাবেক এই শিক্ষক বাংলাদেশের রাজনীতিতেই গুণগত পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রেখেছেন। মুক্ত থাকতে তিনি নিয়মিত সরকারের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সেটা কখনোই শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়নি। তার চরম শত্রু তাকে গালি দিতে পারবেন না। সেই মির্জা ফখরুলের জামিন ঠেকাতেও যখন সরকার মরিয়া হয়ে যায়, তখন বুঝি রাজনীতির জায়গা নিয়েছে প্রতিহিংসা। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দণ্ডিত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ডিত ও পলাতক। মির্জা ফখরুলকেও আটকে রাখলে বিএনপি রাজনীতিটা করবে কীভাবে? সরকারি দলের নেতারা মুখে বলবেন, আন্দোলনে বাধা নেই। আর বাস্তবে রাজনীতির সুযোগ বন্ধ করে রাখবেন, তা তো হয় না। একসময় বিএনপি সন্ত্রাসের রাজনীতি করেছে। ২০১৪-১৫ সালের অগ্নিসন্ত্রাসের কথা তো আগেই বলেছি। তবে বিএনপি এখন সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে চাইছে। কিন্তু সেই পথ রুদ্ধ করাটা রাজনীতির শুভ নয়। আগামী নির্বাচন এখন সবার দৃষ্টিসীমায়। এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় আমরা চাই, প্রতিহিংসা নয়; আলাপ-আলোচনা, সমঝোতায় এগিয়ে যাবে রাজনীতি। তাহলে আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য। 
 

রাজনীতি করতে গেলে হামলা, মামলা, জেল, জুলুম—এগুলো মেনেই করতে হবে। তবে একটা কথা সবারই মাথায় রাখা উচিত, রাজনীতি করাটাই যেন কারও অপরাধ হয়ে না যায়।
 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট