মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় নীতি সুদহার শেষ কথা নয়

ড. মো. আইনুল ইসলাম প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২২, ০৬:০৭ পিএম

মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একযোগে সুদহার বাড়িয়ে চলেছে, তা গত পাঁচ দশকে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে সুদহার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের দেশগুলো। ধনী ও উন্নত দেশগুলোর পথ অনুসরণ করে উন্নয়নশীল বাংলাদেশও রেপো রেট বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৯ সেপ্টেম্বরের এ-সংক্রান্ত এক ঘোষণা ২ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে। সে অনুযায়ী নীতি সুদহার ৫.৫০ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে এখন ৫.৭৫ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছ🐲ে। এর আগে গত ৩০ জুন অর্থনীতিতে অর্থের তারল্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার রেট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫.৫০ শতাংশ করা হয়েছিল। পরিস্থিতি উন্নত দেশগুলোর মতো নাজুক না হলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিও রেকর্ড হারে বাড়ছে এবং কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হালনাগাಌদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের আগস্টে ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে’ সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলোর মতে, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার অন্তত ১২-১৪ শতাংশ। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দরে চলতি বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চার মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১২ শতাংশের বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ ডলারের বিপরীতে ৯৫ টাকা দর বেঁধে দিলেও কার্ব মার্কেটে ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও আমদানি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স নিষ্পত্তি করছে প্রতি ডলার ১০৫ থেকে ১১০ টাকা দরে। সব মিলিয়ে গত চার মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। রিজার্ভের উন্নতি না হলে টাকার দরে পতন আরও হবে এবং একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

সাধারণত মুদ্রার মান পড়ে গেলে কিংবা মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ায়, যাতে নতুন নোট না ছাপিয়ে বিদ্যমান নোট ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া বাইরে চলে না যায়। মূল্যস্ফীতি খুব বেশি বাড়লে ব্যাংক সুদহার সমন্বয় করে বাজারে অর্থ সরবরাহ কিছু কমিয়ে দেয়, যাতে অতি নিম্ন সুদের কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে ফেলার সুযোগ কম পান, অর্থবানেরা টাকা পাচার না করেন এবং অপবিনিয়োগ বা ফড়িয়াগিরি না বাড়ে। বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার নেয়, তা-ই রেপো বা নীতি সুদহার নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যে নীতি সুদহার ব🤡াড়িয়েছে, তাতে কোনো ব্যাংকে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে বেশি সুদ গুনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত টাকার প্রবাহ কমাতে, যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সংকুচিত হবে, বিনিয়োগও কমে যাবে, বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও হ্রাস পাবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে সুদহার বা নীতি সুদহার যতই বাড়ুক না কেন, অতি মুনাফলোভীদের ঋণগ্রহণ প্রবণতা কমে না। এ কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রদানকৃত ঋণের বড় একটি অংশই অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োজিত হয়ে কালোটাকার সৃষ্টি-পুনর্সৃষ্টি ও অর্থ পাচার বাড়ায়, যা জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট করার পাশাপাশি সমাজে তীব্র বৈষম্যও বয়ে আনে। আর ঋণ কার্যক্রম সংকুচিত হওয়ায় ছোট বিনিয়োগকারী ও নতুন উদ্যোক্তদের উৎপাদনশীল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তার কারণ মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট অচলাবস্থা। একদিকে যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম হু হু করে বাড়ছে, অন্যদিকে গম ও ভোজ্যতেলের মতো মৌলিক খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ছে। এর পেছনে উ⛄ৎপাদনজনিত ঘাটতি যত না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সরবরাহজনিত সমস্যা। বিশ্ববাজারে এখন যে চাল, গম ও ভোজ্যতেলের সংকট চলছে, তা উৎপাদনজনিত নয়, সরবরাহজনিত। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্ব খাদ্যচাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান দেয়। এ বছর ইউক্রেনে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে ৮ কোটি টন, যুদ্ধের কারণে যার অন্তত ২০ শতাংশ মাঠেই নষ্ট হয়েছে। বৈশ্বিক গমের চাহিদার ২৫ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৫৮ শতাংশও রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আসে। কাজেই সরবরাহ স্বভাবিক না হলে খাদ্যমূল্য অবধারিতভাবেই আরও বাড়বে। কৃষক মাঠে না যেতে পারায় ভবিষ্যতে গম ও ভোজ্যতেল উৎপাদন নিশ্চিতভাবেই আরও কমবে। যে কারণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সামনের কয়েক মাসে খাদ্যমূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাকে যৌক্তিক বলে ধরে নেওয়া যায়।

২০১৯ সালের শেষার্ধে করোনার শুরু থেকেই বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, এখনো করোনার অভিঘাত সামাল দিতে হচ্ছে, তার ওপর রাশিয়ার ওপর নানামুখী পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা চলছে। এর মধ্যে আবার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন এখনো শূন্য কোভিড নীতিতে চলে সামগ্রিক উৎপাদনপ্রক্রিয়া শ্লথ করে দিয়েছে। এসবের ফলেই মূলত উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতির কোপানলে পুড়ছে। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফജীতির পেছনে নিয়ামক ভূমিকা রাখছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কারসাজিতে ডলারের মূল্যমানে ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ৩০-৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের জ্বালানি ও খাদ্য আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে বাড়তি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে টান পড়ছে, অন্যদিকে করোনার সময় দেওয়া সরকারের বিশাল অঙ্কের প্রণোদনার অর্থ নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর হাতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ💜্টি করেছে।

করোনার অভিঘাত ও বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক সংকটে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশই অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী নীতি সুদহার বাড়িয়ে তারল্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে। অতীতে ꦇঅর্থনীতির এই তত্ত্বের কিছু সুফলও পাওয়া গেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সৃষ্ট অভূতপূর্ব সংকট ও পরিবর্তনে সংকটে জেরবার বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির প্রথাগত অনেক তত্ত্বই খুব একটা কাজে আসছে না। বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদই এখন বলছেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পদ্ধতির অসারতা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ, এই পদ্ধতি অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ বলছেন, ‘বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গণহারে সুদহার বৃদ্ধি ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা হ্রাস করে ও বেকারত্বের হার বাড়তে দিয়ে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটানোর কোনো মানেই হয় না। এই নীতি কিছুদিন চললে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে ঠিকই, কিন্তু তাতে নিম্ন আয় ও সাধারণ মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে।’ পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজারের ফেরিওয়ালা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও বারবার সতর্ক করে বলছে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। এত সব সমালোচনা ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও ডলার দিয়ে আর্থিকীকরণকৃত বিশ্ব অর্থনীতি ব্যবস্থার মূল চালক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক গত সেপ্টেম্বরে এক বছরে রেকর্ড পঞ্চমবারের মতো একধাক্কায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট হারে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে এবং তা আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে। এতে করে গত জুনের যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে চলতি মাসে ৮.৩ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু যে হারে এই দেশটিতে নীতি সুদহার পরিবর্তন করা হয়েছে, তাতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতা প্রত্যাশিত হারের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। অথচ এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। উপরন্তু উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত স্বার্থপর এই আচরণের গূঢ় কারণ হচ্ছে—বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের করা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া এবং সেসব অর্থ দেশটির নবায়নযোগ্য ও প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করে ইউরোপে রাশিয়ার জ্বালানিশূন্য বাজার দখল করা। ইউক্রেন যুদ্ধে ইন্ধন জুগিয়ে আট মাসের মাথায় রাশিয়ার ৬০ শতাংশ জ্বালানি গ্যাস রপ্তানি ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার পর সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই সর্বোচ্চ গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির শীর্ষস্থানটি এখন রাশিয়ার কাছ থেকে নরওয়ের হাতে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সব ধরনের গ্যাসও তেলের বাজার দখলে নিতে জল-স্থল-আকাশের সবকিছুর পাশাপাশি আর্থিকীকরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে ডলার দিয়ে বাজার কারসাজি চিরাচরিত পদ্ধতির আবারও প্রয়োগ করছে। দেশটির স্বার্থপর আচরণ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য চরম বিপদ ডেকে আনলেও নীতি সুদহার ক্রমাগত বাড়িয়ে দেশটি এই বার্তাই দিচ্ছে—মন্দায় পড়ে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠলেও কিছু করার নেই।

এ রকম বিশ্ব প্রেক্ষপটে রেপো বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশকে ভালো করে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মোট চাহিদা পণ্যের ২৩ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি হয়; আর ৭৭ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন ও গতিশীল রাখা গেলে বাংলাদেশের মূল♏্যস্ফীতি ততটা প্রকট আকার ধারণ করার কথা নয়। বাংলাদেশের এখনকার মূল্যস্ফীতির জন্য সাপ্লাই সাইড ইফেক্ট এবং ডিমান্ড সাইড ইফেক্টই মূলত দায়ী। তা ছাড়া এত দিন বাংলাদেশে বাজারের চাহিদা-জোগানের মাধ্যমে সুদের হার নির্ধারিত হয়ে এসেছে। এতে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতেও খুব একটা দেখা যায়নি। বরং এর ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি বিনিয়োগ ও সঞ্চয় লক্ষণীয় পরিমাণ বেড়েছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে হার ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের খারাপ অবস্থার পেছনে সুদ ও নীতি সুদহারের ভূমিকা খুব কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বরং অর্থ পাচার, কালোটাকা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই মুখ্য কারণ বলা হয়েছে। অন্যান্য ব্যয় কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদ বাবদ ২-৩ শতাংশ বাড়তি ব্যয় গুরুতর কোনো সমস্যা তৈরি করে না। উন্নত দেশে বলা হয়, কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ ও নীতি সুদের হার বাড়ালে ঋণগ্রহণ তুলনামূলক ব্যয়সাপেক্ষ হয়। ফলে মুদ্রাবাজারে মানি সাপ্লাই কমে যায় এবং একপর্যায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা বলছিলেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি দ্রুত সহনীয় হবে। কিন্তু তা হয়নি। পরিবর্তিত বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি যে কমানো যাবে না, তা দেশটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তারপরও তারা এ বছর নীতি সুদহার বাড়িয়েছে- বাড়াবে, যার কারণ আগেই বলা হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতির মারপ্যাঁচকর ꧋বর্তমান অবস্থায় বিনিয়োগ ও উপাদনকে বিভিন্ন রকম সুদের ফাঁসে আটকে না রেখে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা কৃচ্ছ ও সংযম সাধন করে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় দিয়ে আমদানি ব্যয়কে অতিক্রম করিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে মূল্যস্ফীতি প্রবণতা কমিয়ে আনা এবং সহনীয় রাখা খুবই সম্ভব। পাশাপাশি আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী আসন্ন ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় ও মন্দার মধ্যেও ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কমিয়ে রাখতে পারবে। এখন বাংলাদেশকে ব্যয় সংকোচনের প্রতি বিশেষ জোর দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন উৎপাদন সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা কার্যক্রম গতিশীল করার পথ সুগম করতে হবে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে—সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে—বড় অর্থনীতির দেশে আর্থিক মন্দা ছোট অর্থনীতির দেশের জন্য শাপে বর হয়। এ জন্য বাংলাদেশকে তার সীমিত সম্পদের সৃজনশীল ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি