গণপরিবহনের দিকে তাকালেই লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি ভয়াবহভಌাবে স্পষ্ট হয়। সম্প্রতি সচেতন মহলের প্রতিটি মানুষের একটিই প্রশ্ন, সড়কে নারী ও পুরুষ কি সমান স্বাধীনতা নিয়ে চলাফেরা করতে পারে? উত্তরটি হবে ‘না’। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার ঝুঁকির ফলে নারীর জীবনে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক ও যাতায়াতের সুবিধা নিশ্চিত না হলে নারী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে কীভাবে? আজকাল অনেক অভিভাবকই রাস্তায় তার মেয়ের চলাচল নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। বিশেষত একজন নারী এমন কোনো কর্মক্ষেত্র বা কাজে যুক্ত হতে পারেন না, যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত তাকে অবস্থান নিতে হয়। অর্থাৎ নারীর সুযোগ কিংবা এগিয়ে যাওয়ার পথে কিছু আশঙ্কা রূপ নিয়েছে শর্তে।
সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানির বিষয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। ওই জরিপে বলা হয়েছে, তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক নারী পরবর্তী সময়ে নানাবিধ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। গণপরিবহনে এসব যৌন হয়রানির মধ্যে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া, বাজে মন্তব্য। জরিপে এ-ও বলা হয়েছে, ঝামেলা এড়াতেই নারীরা প্রতিবাদ করেননি। কারণ, কোনো নারী প্রতিবাদ করলে আশপাশের যাত্রীরা প্রায়ই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালꦐন করেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি।
সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই গণপরিবহন চালক ও চালকের সহকারীর হাতে নারী যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচন🌞া শুরু হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ জানাচ্ছে, নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষরাই বেশি। অনলাইন ও অফলাইনে পরিচালিত এই জরিপে বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির সমীক্ষা পাওয়া গেছে। একুশ শতকে কিশোরী ও তরুণীরা যেখানে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে, সেখানে যৌন হয়রানি নারীর অবদানকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষত গণপরিবহনে নারী নিরাপত্তার অভাবের ফলে সামাজিকভাবেও নানা প্রভাব পড়ে। মোটাদাগে বিষয়গুলো আমাদের চোখে আসে না। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে এর সামাজিক প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শুধু ত🌳া-ই নয়, এই সংকট সমাজের জন্য কতটা ভয়াবহ তা বোঝা দরকার।
সময়ের তাগিদে নারীরা সমাজের প্রতিটি স্তরে অংশগ্রহণ করছে। নারীর অংশগ্রহণে মান🐓বসম্পদ উন্নয়নসহ নানামুখী উন্নয়ন দৃশ্যমান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে আছে। সরকারের আন্তরিকতায় নারীশিক্ষার প্রসার সম্ভব হয়েছে। বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। করোনা মহামারির প্রভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়তে শুরু করে। সেই খবর সংবাদমাধ্যমে বহুবার উঠে এসেছে। করোনা মহামারির প্রকোপ কমতেই আবার দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। নতুন সমস্যা হিসেবে গণপরিবহনে নারী যৌন হয়রানি আবির্ভূত হয়। অবশ্য সড়কে গণপরিবহনের স্বেচ্ছাচারিতা নতুন কিছু নয়। গণপরিবহনে নারীর যৌন হয়রানি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি তা যেন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দূরপাল্লার পরিবহনে নারীরা রাতে চলাচলে দ্বিধাবোধ করত। এখন সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রেও নারীদের দুবার ভাবতে হয়।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, চালক ও চালকের সহকারীর দৌরাত্ম্যের শিকার হতে হচ্ছে নারীদের। হ্যাঁ, তাতে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া হলেও তা উপযুক্ত নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। উন্নত বিশ্বে নারী হয়রানির বিষয়টি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়, আমাদের দেশে তা অতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না। এ কথা সত্য, নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা যৌন হয়রানি রোধে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন।🦩 কিন্তু কারও একার সচেতনতা সামগ্রিকভাবে ফলাফল দিতে পারে না। সে জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। উপযুক্ত আইন প্রণয়ন এবং যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। গণপরিবহনে নারীর যৌন হয়রানির বিষয়টি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি কত দূর? আমরা দেখছি দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই। বরং যৌন হয়রানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি সিটি সার্ভিসে সিটিং ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বাস তাই ইচ্ছেমতো যাত্রী নিচ্ছে। এত মানুষের ভিড়ে একজন নারী খুব সহজেই যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন।
গণপরিবহনের এই অবস্থা নারীদের নানাভাবে অনুৎসাহিত করতে পারে। অনেকে অবশ্য বলেন নারীদের গণপর🍌িবহনে যাতায়াত না করে বিকল্প পদ্ধতিতে যাতায়াত করা উচিত। বাস ও অন্যান্য গণপরিবহনে ভোগান্তি দূর করার দৃশ্যমান ফল না পাওয়ায় অনেকে এমন কথা বলেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দৃশ্যমান ফল কেন আসছে না? নারীর প্রতি সহিংসতা যদি ঘৃণ্য অপরাধ হয়ে থাকে তবে সামাজিকভাবে একে নির্মূল করা কি খুব কঠিন? এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে। কিন্তু গণপরিবহনকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন বিষয়। প্রথমত, আর্থিক দিক বিবেচনায় গণপরিবহন সবচেয়ে সাশ্রয়ী মাধ্যম। দ্বিতীয়ত, গণপরিবহনকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে একটি পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। গণপরিবহনে লিঙ্গ বৈষম্য অত্যন্ত স্পষ্ট। অথচ সমাজে কোনোরকম লিঙ্গ বৈষম্য থাকা মানেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা। সামাজিকভাবে এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না।
মূলত সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ও নিরাপত্তাকর্মীদের উদাসীনতা এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী। কারণ, জনমত গঠনের জন্যে সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। গণমাধ্যমে দিনের পর দিন শুধু সচেতনতার আলোচনা করলেই মানুষের মন বদলে ফেলা যায় না। সে জন্য আইন প্রয়োগ এবং উচিত শাস্তি নিশ্চিত করতে হয়। আইনের প্রতি ভীতি থেকেই শ্রদ্ধা জাগে। এখন অনেক অভিভাবক তার মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পান। রাতে কোথাও যেতে দিতে ভয় পান। বিশেষত গণপরি🏅বহনের প্রসঙ্গ এলেই আতঙ্কিত হন অনেকে। আবার গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে অনেক নারীই কর্মস্পৃহা হারিয়ে বসেন। মানসিক বিপর্যয় থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতেও দেখা গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কি সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের পরিচায়ক? রাষ্ট্র একটু আন্তরিক হলেই এমন সমস্যা নির্মূল করা সম্ভব। হয়তো অপরাধ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না কিন্তু তাই বলে সমাজে এমন অস্থিরতা এবং অরাজকতা ಌচলতে দেওয়ার মানে নেই।
সড়কে গণপরিবহনের স্বেচ্ছাচারিতা ও দৌরাত্ম্য বহুদিনের সমস্যা। নারী-পুরুষ বলে কোনো কথা নেই। সবাই গণপরিবহনে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু নারীদের এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণপরিবহনে যাত্রীদের সিংহভাগই শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী। তাদের পক্ষে অনেক সময় ব্যক্তিগত পরিবহনে চলাচল সম্ভব নয়। তাই নারীর বিকাশের স্বার্থেই গণপরিবহনকে জনꦰবান্ধব করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নারীর জন্য বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বহুদিন ধরেই সচেতন মহল দাবি জানিয়ে আসছে। তাতে পুরো সমস্যা তো সমাধান হচ্ছে না। তাই আপাতত নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন প্রণয়ন জরুরি। বিশেষত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ও আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে গণপরিবহনে নজরদারি বাড়াতে হবে। নারীর অভিযোগ গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং বিচার নিশ্চিতের বিষয়টি নিশ্চিত হলে নির্যাতিত নারী অভিযোগ করার সাহস পাবেন। কাজটি কঠিন হলেও আমরা তাই চাই। আমরা মনে করি, সমাজে স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের এমন বিপজ্জনক পরিসংখ্যানকে দ্রুত স্বস্তিদায়ক সংখ্যায় নিয়ে আসতে হবে। পরিবহন খাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সে বিষয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। শুধু পরিকল্পনা এবং আশ্বাস নয় কিংবা কদিন পর সমীক্ষা প্রকাশেও লাভ নেই। দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী