ক্রিকেটারদের মনের স্বাধীনতা কোথায়?

মানজুর মোরশেদ প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২২, ০১:৫৯ পিএম

দুই কানের মধ্যে যে ৬ ইঞ্চির ব্যাস, এর মাঝে তার অবস্থান! তাকে আপনি ব্রেন বা মস্তিষ্ক নামে চেনেন। বিজ্ঞান বলে ওর মধ্যেই আবার বিন্যাস রয়েছে—গুরুমস্তিষ্ক, মস্তিಌষ্ককাণ্ড ও লঘুমস্তিষ্ক। আর এই তিন অংশে সাড়ে আট হাজার কোটির বেশি স্নায়ু আছে! ভাবুন তো এই মস্তিষ্কের প্রয়োগ কত ভিন্ন🎉 হতে পারে মানুষভেদে? এই অবতারণার হেতু ক্রিকেট খেলাকে বলা হয় ‘মাইন্ড গেম’। খেলাটির দারুণ সব অ্যাম্বাসেডর আছেন—ডন ব্রাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার, গ্যারি সোবার্স, ইমরান খান, জ্যাক হবস; এরা প্রত্যেকেই ওই মাইন্ড গেমে ক্ষুরধার ছিলেন, হতে পেরেছেন কালোত্তীর্ণ! এই পৃথিবী ক্রিকেট নামের জেন্টলম্যান খেলাটিতে অবিশ্বাস্য অসাধারণ সব প্রতিভা দেখেছে কালে কালে! তারা সামর্থ্য, মেধা, প্রয়োগে কেউ কারও চেয়ে কম নন; চাইলে ৩০ জনের এমন একটি তালিকা খুব সহজেই করা যাবে। আসলে বীর অনেকেই হন, কিন্তু ইতিহাস মনে রাখে তাকে, যে কিনা ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারে! আসলে অপেক্ষা করতে হয় ওই সময়ের, ওই ক্ষণের,  ও্ই পলের জন্য। আর ওই সংকেত,  ওই বিচার, ওই বুদ্ধি, ওই প্রয়োগ, কোথা থেকে আসে? সেকেন্ডের ভগ্নাংশে মস্তিষ্ক সিগন্যাল পাঠায়, আর হয়ে যায় কাজের কাজটি। হয় ইতিহাস! 

জগতের অপেক্ষার সবচেয়ে ক🍬াঙ্ক্ষিত পৌনঃপুনিক ক্রিকেট লড়াইয়ে এই কাজটি করে এই মূহুর্তে ক্রিকেট দুনিয়ায় প্রশংসার সাগরে ভাসছেন হার্দিক পান্ডিয়া নামের এক বীর! মোহাম্মদ নাওয়াজের আর্ম ডেলিভারিটিকে জোরে হিট করলেও এক্সট্রা কাভারে সরাসরি ফিল্ডারের কাছে চলে যায়। নো রান, কিন্তু পান্ডিয়া নির্বিকার! পরের বলটিতে কী করতে হবে জানতেন, ব্যবহার করলেন ক্রিকেট মাঠের কাউ কর্নার। বল উড়ে চলে গেল গ্যালারিতে; চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারায় ভারত। যখন বল হাতে নিয়েছিলেন তখনো হার্দিক অনন্য। ভারতীয় অন্য পেসারদের থেকে তিনিই সবার আগে শারজার উইকেটটাকে ধরতে পারলেন। লেংথ কী হবে, কোন পেসে বল করতে হবে ! পাকিস্তানি ব্যাটারদের ব্যাকফুটে খেলার প্রবণতা কম, আর তাই শর্ট বলে ক্রমাগত আক্রমণ করে গেলেন। ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে গতি, বল স্কিড করালেন আর তাতেই ভেঙে দিলেন পাকিস্তানের ব্যাটিং মেরুদণ্ড। বাবর-রিজওয়ানদের মনের মেরুদণ্ডও কি নয়?

‘মনের ওপর তো জোর চলে না’—কথাটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কমবেশি ব্যবহার হয়। জোর খাটালেই নাকি বিগড়ে যায় মন, তখন জানা কাজেও ভুলভাল হয়। সবাই বলে, ‘অকাজের লোক’। এই অকাজের লোকের আধিক্য এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে। তাদের একেকজনের মস্তিষ্কের সাড়ে আট কোটি স্নায়ু প্রায়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, আর তাই মেধাবী ক্রিকেটার হয়েও ২২ গজে বিফল হয় তারা। এমনিতে এ দেশে ক্রিকেট পরিচালিত হয় ‘পরীক্ষার আগের রাতে পড়া’র কৌশলে; এখানে ছাত্র (পড়ুন ক্রিকেটার), শিক্ষক (পড়ুন কোচিং স্টাফ), পরিচালনা পর্ষদ (পড়ুন বোর্ড) সবাই শর্টকাটে বিশ্বাসী। সাফল্যের ভাগ সবাই নেবে কিন্তু ব্যর্থতার নয়, যার পাল্লাটা সব সময় ওজনদার। স্কেপগোট বা বলির পাঁঠা যা-ই বলুন, সেটা হতে হবে ক্রিকেটারকে, অথবা কোচিং স্টাফকে, অথবা নির্বাচককে; কিন্তু সিস্টেমটাকে যা🃏রা আধুনিক হতে দেননি, তাদের যেন কোনো দায় নেই! আর এই ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর কারণে এ দেশের ক্রিকেটাররা নাকি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারেন না—এমন ক্ষেপণাস্ত্র সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে নিক্ষেপ করেছেন কার্যত বিদায়ী কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। ধরে নিচ্ছি যাওয়ার বেলায় এমন কিছু কথা বলে ক্রিকেটাঙ্গনে তোলপাড় তোলা হয়তোবা তার উদ্দেশ্য! কিন্তু এড়ানো কি যাবে? মনে হয় না। সিনিয়র ক্রিকেটাররা সবাই গত ৬-৭ বছরে এত খামখেয়ালিপনা দেখিয়েছেন, তা নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব! কাউকে অপার স্বাধীনতা দিয়ে একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে, কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় পাননি। বিসিবি সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই আলগোছে ক্রিকেটকে মেপেছেন অর্থকড়ির মানদণ্ডে। ক্রিকেটিয় চেতনা লুপ্ত হলে, একটা দলের অবস্থা কী দাঁড়ায়, তার প্রমাণ এখন হাতেনাতে। একজন ক্রিকেটার যদি ক্রিকেট চেতনায় স্বাধীন না হন, তার দায়টা অবশ্যই প্রথমে বোর্ডকে নিতে হবে? 𓃲বোর্ড কি নেবে? নেবে না, কারণ এখানে আছে একধরনের স্বৈরশাসন!

সাকিব আল হাসান যতই চেষ্টা করুন, অর্কেস্ট্রায় ততক্ষণ সুর উঠবে না, যতক্ষণ আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে ক্রিকেটারদের মনে। সাইফউদ্দিনের ক্রিকেট মস্তিষ্ক হয়তো হার্দিক পান্ডিয়ার মতো ক্ষুরধার নয়, তবে আদর্শ মানতে দোষটা কোথায়? একদিন𓄧 হয়েও যেতে পারে। বিশ্বাসটা রাখতে হবে। শুধু বিসিবির কাছে অনুরোধ, একজন ক্রিকেটারের সাড়ে আট কোটি মস্তিষ্ক কোষকে শুধু ক্রিকেট নিয়েই ভাবতে দিন। তাতে আখেরে আপনাদেরই লাভ। নিশ্চিন্তে বিসিবি শাসন করতে পারবেন।

 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন