জ্বালানি, ভোজ্যতেলসহ নানাবিধ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া বাজারের আলোচনা-সমালোচনায় আমরা যেন ভুলে না যাই যে আজ ১৭ আগস্ট। ২০০৫ সালের এই দিনে এক নজিরবিহীন জঙ্গি হামলা হয়েছিল বাংলাদেশে। মুন্সিগঞ্জ জেলা বাদে দেশের বাকি ৬৩টি জেলায় একযোগে একই সময়ে বোমা হামলা🥃 চালায় নিষিদ্ধঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নাম🐼ের একটি জঙ্গি সংগঠন। পরিকল্পিতভাবে দেশব্যাপী এ হামলা চালানো হয়। প্রায় ৫০০ পয়েন্টে এ হামলা হয়। এতে দুজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ১০৪ জন।
১২ বছর ধরে সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পাকিস্তানের এলিট শ্রেণির শোষণব্যবস্থার বিলুপ্তি সাধনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সেই আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, যার আজীবনের প্রেরণার প্রধান উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বগুণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান প্রশ্নে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও চরম পরাজয় হয়েছিল। যার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবার হত্যার মাধ্যমে। এর কদিন পর ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম চার সাথি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মদদপুষ্ট খুনিরা। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী সমস্ত অপরাধ সংঘটনের মূল হোতা জামায়াতের আমির যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করে দেশে জঙ্গিবাদের উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। জিয়াউর রহমান একদিকে গোলাম আযমকে ফিরিয়ে আনেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে ৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চাষ শুরু। সেই চাষেরই এক ভয়ংকর ফসলের নাম জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদ🍎েশ (জেএমবি)। জামায়াত আর বিএনপির সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ কীভাবে বিকশিত হয়েছিল, বাংলাদেশে তার বড় প্রমাণ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা সদস্য সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই। এই কুখ্যাত বাংলা ভাইকে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধী নিজামী বলেছিল এই জঙ্গি নাকি মিডিয়ার সৃষ্টি!
বঙ্গবন্ধু সপরিবার খুন হয়েছিলেন আগস্ট মাসে। ২০০৫-এর আগস্টেই সিরিজ বোমা হামলা হল। আবার ২০০৪-এর ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ সব আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে মেরে ফেলার জন্য ঢাকায় পার্টি অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রায় গ্রেনেড হামলা হলে দলের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েক শ নেতা-কর্মী আহত হন। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে যান, তবে তাঁর কানের স্থায়ী ক্ষতি হয়। ‘ফিরে দেখা: ভয়াল ২১শে আগস্ট’ শীর্ষক একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে যে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং তার স্ত্রী (খালেদা জিয়া) যে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে এবং ছেলেকেও সেই একই পথে নামিয়েছে, এটা তো স্পষ্ট।” ওই হামলার আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কয়েকটি বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “সে বক্তৃতা দিল যে আওয়ামী লীগ এক শ বছরেও কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, আরেকবার আরেক বক্তৃতায় বলল যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এই যে তার বক্তব্য এর মধ্য থেকেই তো বোঝা যায় যে তাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল। আর এর সঙ্গে যে সরকারের সবাই জড়িত ছিল, এটা তো খুব স্পষ্ট।” খালেদার সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, তখনকার ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। “তাদেরকে নিয়েই কিন্তু এ সমস্তই চক্রান্তটা করে এবং সব থেকে বড় কথা হচ্ছে তার ছেলে তারেক রহমান। সে তো দীর্ঘদিন এই ষড়যন্ত্র তৈরি করা এবং এটাকে কার্যকর করার জন্য সব থেকে মুখ্য ভূমিকা তো সে তৈরি করেছে। খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই তার পেছনে ছিল এবং তাকে সমর্থন দিয়েছে।”
একুশে আগস্টের মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে এখন পর্যন্ত ২০ বার জঙ্গি হামলা চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার জোরালো সব প্রমাণ দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী সামরিক কর্মকর্তারা দেশবাসীসহ আন্তর্জাতিক মহলের সামনে হাজির করেছেন। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক, অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার সরকারসমূহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে-বিদেশে পুনর্বাসন করেছে। আর এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় পেছন থেকে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার নিশ্চিতসহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির মহান সংগ্রা🍃মে নিয়োজিত আছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি তাঁর বোন শেখ রেহানাসহ বিদেশে থাকায় ৭৫ সালে বেঁচে গিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের সরকার ৬ বছর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরতে দেয়নি। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণ সংগ্রাম শুরু করেন। বাংলাদেশের মানুষকে জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের সেবায় উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে ক্রমাগত লড়াই করে চলেছেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব অর্জন করেন। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও আমেরিকার প্রেসক্রিপশনে গ্যাস বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় আওয়ামী লীগকে ২০০১ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী নির্বাচনও জালিয়াতি করার মানসে দেড় কোটি ভুয়া ভোটার বানায় বিএনপি-জামায়াত জোট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের একপর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতায় আসে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মিথ্যা ও সাজানো মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাইনাস করার পাঁয়তারা করে সেই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানবতার জননী শেখ হাসিনা একটি ভুয়া ভোটারবিহীন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করে তৎকালীন প্রশাসনকে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের অপপ্রয়াস থেমে থাকেনি। শেখ হাসিনার সরকার তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এখনো জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে অন্ধকারের শক্তি। তবে বাংলাদেশ সরকার যেকোনো মূল্যে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ এবং চিরতরে বিলুপ্ত করার মহান ব্রত নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অর্জনের পরেও চলমান সময়ে বাংলাদেশের সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে নানাবিধ সংকট তৈরি হয়েছে। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ একশ্রেণির ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলার দুর্নীতিপ্রিয়তার ফলে শেখ হাসিনার সাফল্য শতভাগ হয়নি। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে সামরিক ও বেসাꦛমরিক আমলাতন্ত্রনির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনায় গেড়ে বসা নৈরাজ্যের সিস্টেমে শেখ হাসিনার পক্ষে শতভাগ সাফল্য নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা খুবই কঠিন কাজ। সীমিত আয়ের মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। এখানেই দেশবাসীকে সতর্ক হতে হবে। বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীলতা কিংবা একশ্রেণির আমলা আর রাজনীতিবিদের দুর্নীতিপ্রিয়তার ফলে আবারও বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র আর জঙ্গিবাদের মদদদাতা গোষ্ঠী যেন রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসার পাঁয়তারা করতে না পারে, সে জন্য দেশবাসীর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করꦦি, বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের বদনাম থেকে রক্ষা করেছেন শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে বলে আমাদের দৃঢ় আশাবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বা সরকারের কথায় কান না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের ওপর ভরসা রেখে যার যার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে হবে।
লেখক : বিশেষজ্ঞ সদস্য, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ