১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বেগম ফজিলাতুন্নেছা (রেণু) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরা🐲ত্রিতে বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গ🔯ে তিনিও নির্মমভাবে নিহত হন। বঙ্গমাতা খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান। তবে শৈশবেই তাঁর মধ্যে সাহস, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ একজন বাঙালি নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
৪৫ বছরের জীবনের সবটাই বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে গিয়েছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (রেণু)। কলকাতায় কলেজে অধ্যয়ন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় বঙ্গবন্ধুকে কখনো সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে দেননি ত💫িনি। নিজেকে আড়াল করে সর্বদা পেছন থেকে সহায়তা দিয়েছিলেন স্বামীকে। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখার সময় বারবার প্রিয় রেণুর গল্প, তাঁর ধৈর্য ও সহনশীলতা গুণের কথা স্মরণ করেছেন। তাঁর স্ত্রীর দূরদর্শিতা, ধৈর্য ও সাহস তাঁকে জনগণের জন্য কাজ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। তিনি সুপরামর্শ ও সৎসাহস দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করে গেছেন।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর ধৈর্য, সাহস, নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার কথা। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক হওয়ার অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথඣারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পিতা যা বলেছিলেন, তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল, তা এই উদ্ধৃতিতে দেখা মেলে, সেখানে বেগম মুজিবের কথাও আছে—‘আব্বা বললেন, ‘‘আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। আমি আব্বাকে বললাম,♔ ‘‘আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না। আমাকে আর কিছুই বললেন না। রেণু বলল, ‘‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে। আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’
সহধর্মিণী যথার্থই সহযাত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। তাঁর আত্মত্যাগকে আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন। গ্রন্থের বাক্যে বাক🐻্যে তা স্মৃতিময় হয়ে আছে অনেক জায়গায়। বেগম মুজিব কেবল শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতীক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভালোবাসায়, মমত্ববোধে অনন্য। এতিম ও স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু স্বশিক্ষিত একজন নারী—পরিবার, সংসার এবং শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর অসহায়ত্ববোধও ছিল স্পষ্ট।একদিকে সংসার- ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ব্যয়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি অন্যদিকে নির্ধার𓆉িত আয় নেই বললেই চলে; এমনকি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা না দেওয়ায় ১৯৬৬ সালে অসুবিধা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। বেগম মুজিবই যে বুদ্ধিমত্তা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে সংসার চালিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধু সরাসরি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
১৯৫৪ সাল থেকে বেগম মুজিব ঢাকায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন তাঁর সচেতন ও সতর্ক এবং পরিস্থিতি মোকাব🍌েলার শক্তি সম্পর্কে। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবিনামা প্রকাশ করে প্রচারণা শুরু করলে ১৯৬৬ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সে সময় বেগম মুজিব কেবল নিজের ঘর-সংসার-সন্তান সামলে চলেননি বরং অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে একজন সচেতন নারী হিসেবে নেতাদের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। সংসারের গণ্ডি অতিক্রম করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বেগম মুজিব। তিনি আন্দোলন সংগ্রামে হয়ে উঠেছিলেন গেরিলা যোদ্ধার মতো সতর্ক কর্মী। ছয় দফা দাবি আদায়ের লড়াইয়ে গোপনে প্রচারণা চালানো থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন তিনি। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশের অবস্থা বর্ণনা, সংগঠনের অবস্থা অবহিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তা হুবহু পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন বেগম মুজিব।
বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাক সামরিক সরকার। ছয় মাস পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস ছিল না, আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না। এরপরে কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখান, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন।’ ‘আম্মা সোজা বলে দিলেন, কোনো প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোনো মুক্তি হবে না।’ ‘আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি তারা বলেছেন, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে—ভাবি আপনি কিন্তু বিধবা হবেন।’ ‘আমার মা তখন কঠিন স্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৩ জন আসামির কী হবে। বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বেগম মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্ষুর আড়꧙ালে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে ছাত্রদের তিনি নির্দেশনা দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করেও অর্থ জুগিয়েছেন। অন্যদিকে 💛বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বিকেলের কথা আছে শেখ হাসিনার লেখায়। সেদিন ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তোমার যা মনে আসে তাই তুমি বলবে। তুমি রাজনীতি করেছো, কষ্ট সহ্য করেছ, তুমি জান কী বলতে হবে। কারও কথা শোনার দরকার নাই।’ ‘এই লাখো জনতা যেন হতাশ হয়ে না যায়। আবার পাকিস্তানিরা যেন গোলাগুলি করে এদের শেষ করে দিতে না পারে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বেগম মুজিব♚ের মনোবল ছিল আশাজাগানিয়া। ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছেন। শেখ হাসিনা, রেহানা, রাসেল তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দী। যোগাযোগ এ🦩কেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু তিনি হতবিহবল হননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, তিনি দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন। তবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ফার্স্ট লেডি হওয়া সত্ত্বেও বিলাসিতা ত্যাগ করে তিনি এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।
মূলত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা🌼 ছিলেন জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি এবং সাহসের এক অনন্ত উৎস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মহাꩲপ্রয়াণের পরও তিনি আজও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়