নারীবিদ্বেষী পুরুষরা যখন একজোট, মুক্তি কত দূর?

প্রমা ইসরাত প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১, ০১:১৫ পিএম

আমাদের দেশের সমাজ শুধু পুরুষতান্ত্রিকই নয়, বরং বলা যায় এটি নারীবিদ্বেষী সমাজ। এই সমাজব্যবস্থায় যেকোনো স্তরে থাকা যেকোনো ছোট-বড় পোস্টে কর্মরত বহু মানুষ মূলত নারীবিদ্বেষী। কোনো নারী উন্নতি করে ফেললে বা দাপট দেꦉখিয়ে ফেললেই, তাদের রক্তচক্ষু সেই নারীর ওপর গিয়ে পড়ে। তারা মনে মনে নারী𒉰 কেমন হবে, এই রকম একটি সিলেবাস তৈরি করেন এবং সেই সিলেবাসের বাইরে থাকা যেকোনো নারীই তাদের চোখে, পতিত, কিংবা অব-মানব।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সম্পূর্ণ বা পূর্ণ মান🦋ুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সব সময় নারীকে দেখা হয় পুরুষের অধস্তন হিসেবে। সেই সমাজে আরও বাজে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়, বিনোদন জগতে যারা কাজ করেন, সেই সব নারী শিল্পীদের।

তাদের নিয়মিত টেলিভিশন সিনেমার পর্দায় দেখে মানুষ আমোদিত হন, বিনোদিত হন, কিন্তু দিন শেষে সবচেয়ে বেশি আক্রোশের শ🌸িকার তারাই হন।

সেই অনেক আগে থেকেই একটি কথা বলা হতো যে ‘সিনেমায় নেমেছে’। মানে, সিনেমা যেন একটা নর্দমা, ডোবা জায়গা যেখানে নামতে হয়, যেখানে নামলে আর ওঠা যায় না। মানে সমাজের দৃষ্টিতে যারা সিনেমায় নামে তারা যেন মর্যাদায় নিচে নেমে যায়। কিশোর বয়সে ম্যাগাজিনে পড়তাম তখন সিনেমার নায়িকারা বাইরে ব্যক্তিগত কাজে বের হলে বোরকা পরে বের হতেন, যেন লোকজন তাদের চিনতে না পারেন। বিয়ে করে সংসার শুরু করলে, সেই সিনেমার জগৎকে এমনভাবে ছুড়ে ফেলতে চাইতেন, যেন সেটা তাদের দেহের কোনো টিউমার। ধর্মীয় পোশাক ও ধর্মভ♎িত্তিক জীবনযাপন করে মানুষকে বোঝাতে চাইতেন যে তারা ভালো হয়ে গেছেন, তারা সিনেমায় যে ‘নেমেছিলেন’ সেখান থেকে ওপরে উঠে গেছেন।

কেন? কারণ, সমাজে পর্দায় নায়িকাদের নাচ দেখতে ভালোবাসলেও, মাꦑনুষ হিসেবে সম্মান দিতে চান না সমাজের মানুষেরা। তাদের মানসিকতা হচ্ছে, এটা তো সার্কাসের বানরের মতো একটা কিছু, যা দেখে আমরা বিনোদিত হই, একে মানুষের মর্যাদা দেব কেন। আর যদি দিইও নায়িকাদের দেব কেন, এরা তো ‘মাইয়া’ মানুষ। আর সিনেমায় নামা নায়িকারা তো পতিত। 

এই বঙ্গদেশে বিনোদনের জন্য কাজ করতে আসা নারীরা যতটুকু না শিল্পী বা প্রফেশনাল, তার চেয়েও বেশি ভোগ্যপণ্য। সিনেমায় বা মিডিয়ায় কাজ করতে এলে কাস্টিং কাউচের শিকার হতে হয় অনেক মেয়েকে। কাজ পাওয়ার জন্য অনেকেই প্রডিউসারদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে বাধ্য হন, যা যৌন শোষণ। বেশির ভাগই চেপে যান, নইলে এই জায়গা থেকে বের হয়ে নিভৃতে চলে যান। ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে ক্ষমতাধর পুরুষদের খুশি করে চলতে হয়। যাদের ব্ཧযাকআপ নেই, একেবারেই কোনো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া যারা মিডিয়ায় কাজ করতে এসেছেন, তারা ঠিক যেমন অসহায় তেমনি সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার। সমস্যা হচ্ছে, বিনোদন জগতের এই পুরো বিষয়টিকে কাজ হিসেবে দেখে না কেউ এখানে, প্রায় সব মানুষ এটাই ভাবে যে, যে জায়গায় যে কাজে তারা আছে, তারা বেসিক্যালি পাপ করছে। বাঙালি মুসলমানের সন্তান যেহেতু, তাই তাদের চিন্তাধারায়, মননে ও মগজে, নাটক-সিনেমা এবং মিডিয়ায় কাজ করা মানে পাপ। এবং কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো নারী আর্টিস্টকে প্রফেশনাল কাজের বাইরে প্রডিউসার বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা যৌন প্রস্তাব যেমন দেন, তেমনি সুবিধা আদায়ে অনেক নারী এই যৌনতাকেই বেছে নেন।

সমাজের উচ্চস্তরে বড় বড় পোস্টে আসীন, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাই নিজেদের স্পন্সরে ভোগ্যপণ্যের মতো নিজেদের ব্যক্তিগত ‘মডেল’ হাতে রাখতে পছন্দ করেন। এটা যেন সেই আদিম যুগের🥂 রাজা-বাদশাহ বা জমিদারদের সময়ের একটা আধুনিক চিত্র। যার যত টাকা, যার অধিকারে যত নারী, যার যত ভোগবিলাসিতা, সে যেন ঠিক তত বেশি ‘পুরুষ’।

বিপত্তি বাধে যখন তাদের হাতে পুতুলের মতো বন্দি থাকা মডেল বা নায়িকারা মানুষের মতো কথা বলতে যায় তখন। যখন তারা কোনো কারণে হুমকি দেয় যে, ভদ্র চেহারার মুখোশ খুলে দেব বা ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে,  তখন সেই সব ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের টনক নড়ে, এবং তারা যেকোনোভাবে সেই সব নারীকে দমনের জন্য উঠে-পড়ে লাগে। কারণ, তারা একটা সভ্যভব্য ‘ফ্যামিলি ম্য🎃ান’ সেজে সমাজে নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘোরেন, সেই ভদ্র পারিবারিক ইমেজে কালিমা লেপন হয়ে গেলে তো সব ভজঘট পাকিয়ে যাবে। কারণ, মননে মগজে তারা মধ্যযুগে বসবাস করলেও আসলে তো সময়টা মধ্যযুগ নয়।

মিডিয়ায়, সিনেমায়, নাটকে কাজ করতে যারা আসেন, তারা নারী পুরুষ, রূপান্তর💧কামী যে হন না কেন, তাদের প্রত্যেকেরই মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করার অধিকার আছে। নাটক সিনেমায় বা বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করে বলেই, মডেলিং করে বলেই𝕴, থিয়েটার করে বলেই একজন নারীর চরিত্র খারাপ, একজন নারী সহজলভ্য, একজন নারী খুবই সস্তা, সমাজের এই প্রাচীন নোংরা চিন্তা দূর করতে হবে। খুবই অবাক লাগে সেসব পুরুষ দেখলে যারা একই সঙ্গে বিনোদন জগতের নারীদের কামনা করে আর তারপর বিভিন্ন জায়গায় নারীবিদ্বেষী ধর্মীয় বয়ান শুনেন। আড়ালে প্রত্যেকেই সেই নারীদের নিজেদের শয্যায় চান, মনে মনে ভাবেন এই নারী শয্যায় চলে এলে আমি ‘শ্রেষ্ঠ’ পুরুষ হতাম। ওই আসল পুরুষ হতে না পারার দুঃখে, সেই নারী যখন কোনো কারণে বিপদে পড়েন। তখন সেই নারীকে বেশ্যা, পতিতা আরও নানান ভাষায় নিজেদের আক্রোশ দেখাতে থাকেন। 

নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং নারীকে যৌনসামগ্রীরূপে ব্যবহার করা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। যারা এই ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে শোষণ করে আধুনিক যৌনদাসী বানিয়ে রাখতে চায়, শাস্তি হ🐎ওয়া উচিত সবার আগে তাদের। কিন্তু ভার্তৃত্ববোধে উজ্জীবিত সমাজের উচ্চবিত্ত ভদ্রবেশী মুখোশ পরা এসব মানুষ যখন এক জোট হোন, এবং নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলা দেখানোর জন্য, নারীদের হেনস্তা করতে থাকেন, তখন মনে হয়, মুক্তির পথ অনেক অনেক দূর।

 

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী