সকল ভয়কে উপেক্ষা করেই উদযাপিত হবে উৎসব

তুষার আবদুল্লাহ প্রকাশিত: এপ্রিল ১৫, ২০২২, ০১:২২ পিএম

যখন ছোট ছিলাম, তখন মা চক দিয়ে বৃত্ত এঁকে দিত। ওই বৃত্তের বাইরে বের হওয়া বারণ। আমাকে ওই বৃত্তে রেখে মা তাঁর কাজগুলো শেষ করতেন। মায়ের বৃত্ত উঠে যাওয়ার পর যখন বাইরে বের হলাম, দেখি বৃত্তের শেষ নেই। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র চকপাউডার নয়, লোহার শিকল দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে রেখেছে। অদৃশ্য হলেও, সেই শৃঙ্খল কঠোর। কিন্তু সেই কঠোর শৃঙ্খলের বৃত্তে মানুষকে আটকে রাখতে বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর, ফন্দি আঁটা হলো ভয় দেখানোর। শুধু মুখে মুখে ভয় দেখানো নয়। ঘটনা ঘটিয়েই চোখ রাঙানি দেওয়া হলো। কিন্তু তাতেও দমিয়ে রাখা গেল না এক মুহূর্তও। বরং ভয় ব্যবহৃত হলো শক্তি রূপে। তখন ভাবা হলো, এদের জোটবদ্ধ রাখা যাবে না। বিচ্ছ✃িন্ন করে দিতে হবে। শুধু বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া নয়, পরস্পরকে ধ্বংস করার নেশা ধরিয়ে দেওয়া হলো। এখন সেই ধ্বংসের চক্রকাল চলছে।

২০০১ সালের পয়লা বৈশাখ রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাটি ছিল বাঙালি বা বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত। এটি হঠাৎ মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো ভাবনা ছিল না। গভীর ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই আঘা𝓰তটি করা হয়েছিল। আমরা দমে যাইনি। পরের বছরের উদযাপনে উল্টো ভয়কেই চোখ রাঙিয়েছি। কারণ, এই উদযাপনের দেখা তো আমরা নগরে এসে পাইনি। গ্রাম থেকে বা আমাদের আবহমান বাংলার আচার, জীবনের অনুষঙ্গ চৈত্রসংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ এবং নানা সময়ের আড়ং। এমন নয় যেকোনো একটি ধর্মের মানুষ এসব আচারে যোগ দিতেন। গ্রামের সব ধর্মের মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে এসব উৎসবের আয়োজন করতেন এবং উদযাপন ছিল সম্মিলিত। তখনো বাঙালি মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করতেন। বরং নির্ভেজালভাবেই করতেন। নির্ভেজাল এই অর্থে বলছি, এখন আমরা নানা অপকাজে যুক্ত হয়ে দৃশ্যমান ইবাদত করে যাই। মুসল্লির সৌন্দর্য হারাতে বসেছি। তখনো গ্রামেগঞ্জে কুসংস্কার ছিল, এসব কিছুকে নিয়েই বাঙালি উৎসবে হতো মাতোয়ারা। যেমন নববর্ষে, পূজাতে, তেমনি ঈদ উদযাপনে। বাঙালি সংস্কৃতির  সুন্দর রূপটি এমন নিখাদই ছিল।

খাদ মেশাতে হলো এই জন্য যে বাঙালিকে আলোকিত থাকতে দেওয়া যাবে না । থাকতে দেওয়া হবে  না🦄 অসাম্প্রদায়িক। বাঙালি শক্তিমান হলে আঁধারের সর্বনাশ। আঁধারের এক অশুভ বাণিজ্য আছে। সেটি যেমন আর্থিক, তেম🤪নি রাজনৈতিকও । বিষয়গুলোকে সহজ গণিতে স্থানীয়করণ করা বোকামি হবে। এর আন্তর্জাতিক বীজগণিত, জ্যামিতির ব্যাপ্তি  রয়েছে। ‘স্থানীয় ‘ সেই গণিতের অঙ্ক মাত্র।

ফলে যখন চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী বলী খেলা বন্ধ হয়ে যায়, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় বৃত্ত টানা হয়। উৎসবে ঘড়ি বেঁধে দেওয়া হয়, তখ🍬ন চোখকে ছোট ডোবায় নামিয়ে আনতে চাই না। কারণ জানি, দেখে আসছি আমরা বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তি অনেক পরাশক্তির জন্যও স্বস্তির নয়। তাই জুজুর ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখার মরণ লড়াই তাদের আছেই। তারা কিন্তু খুব কৌশলেই একটি সর্বনাশ ঘটিয়ে দিতে পেরেছে, এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রশ্নের মুখে ফেলছি: মঙ্গল না আনন্দ? বর্ষবরণ, পয়লা বৈশাখ উদযাপন কি সর্বজনীন নাকি বিশেষ ধর্মের? গত তিন-চার দিন খুব কাছের বন্ধু, গণমাধ্যমের কতিপয় সহকর্মীদেরও যখন ওই দলে যোগ দিতে দেখলাম, তখন বুঝে গেলাম সত্যি আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

কিন্তু আমাদের তো কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা যে চির দুরন্ত দুর্মদ বিদ্রোহী। মুক্ত জীবনানন্দ। আমাদের কোনো বৃত্ত বা শৃঙ্খলে আটকে রাখা সম্ভব নয়। ছলের শিকল ভেঙে আমরা রোদ্দুরেই গিয়ে দাঁড়াই। এই তো দাঁড়িয়েই আছি, বাংলা ছবির সেই রাম রহিম জন কাঁধে কাঁধ রেখে। আপনারা নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন আমাদের বাজানো পাཧতার বাঁশি?

 

লেখক: সাংবাদিক