সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তারে দারুণ চাপের মুখে পড়েছে গণমাধ্যম। দ্রুতই ঘুচে যাচ্ছে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবধান। ফলে তথ্য আর গুজবের ফারাকও দ্রুত কমে আসছে। গুজবকেই অনেকে সত্য হিসেবে ধরে নিচ্ছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই তথ্য পাওয়ার মূল উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন। এটা ভয়ংকর প্রবণতা। গণমানুষ যে গণমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, গণমাধ্যমে আস্থা রাখতে পারছে না; এর দায় অনেকটাই গণমাধ্যমের🔯। তথ্যই সবচেয়ে শক্তিশালী। আর মানুষের তথ্য জানার চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা অসী💟ম।
মানুষ সবকিছু জানতে চায়। ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। তথ্য মানে কিন্তু শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রাইম আর খেলাধুলা নয়। স্কুল কবে খুলবে, পরীক্ষা কবে হবে; একজন শিক্ষার্থীর কাছে এই যতটা জরুরি; তেমনি আগাম বন্যা হবে কি না, অতিবৃষ্টির আশঙ্কা আছে কি🐬 না; একজন কৃষকের কাছে সেই তথ্য ততটাই জরুরি। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম গণমানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারছে না বলেই মানুষ বিকল্প উৎস খুঁজছে। তাই মানুষকে দোষ না দিয়ে গণমাধ্যমকেই নিজেদের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে হবে, গণমানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হব♉ে।
বাংলাদেশে এখন গণমাধ্যমের জোয়ার বইছে। বিকাশের চূড়ায় উঠেছে। সরকারি দলের নেতারাও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন এলেই এই সংখ্যাধিক্যের কথা বলেন। তারা সংখ্যাকেই গণমাধ্যম♊ের স্বাধীনতার সূচক হিসেবে বিবেচনা করতে চান। কিন্তু কোয়ান্টিটি বাড়লেও কোয়ালিটি বাড়েনি মোটেই। বরং কোয়ালিটিতে ধꦆস নেমেছে। গণমাধ্যমের সংখ্যা যত বেড়েছে, আস্থা যেন ততই কমেছে। গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে না পারলে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎই হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, মানুষ যদি না দেখে বা না শোনে বা না পড়ে তাহলে টিভি, রেডিও, পত্রিকা বিজ্ঞাপন পাবে না। আর বিজ্ঞাপন কমে গেলে আস্তে আস্তে অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। মানুষ যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরসা খুঁজছে, বিজ্ঞাপনদাতারাও তাই সেদিকেই ঝুঁকছে।
দৃশ্যত গণমাধ্যমের মূল দায়িত্ব সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ। তবে শুধু তথ্য সরবরাহই গণমাধ্যমের কাজ নয়। প্রাপ্ত তথ্য সম্পাদকীয় বিবেচনা প্রয়োগ করে সরবরাহ করাই আসলে গণমাধ্যমের কাজ। সব তথ্যই প্রকাশযোগ্য নয়, সব সত্যও সব সময় সংবাদ নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেকোনো তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই, পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হবে; তা বিবেচনা ছাড়াই প্রকাশ করতে পারে, অধিকাংশ সময় তা করেও। কিন্তু গণমাধ্যম যাচাই-বাছাই তো বটেই, পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে তবেই সে তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা দিতে পারে; এসব তথ্য আপনি প্রচার করতে পারবেন না। গণমাধ্যম এটা মেনে চললেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বালাই নেই। তাই তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও সৃ🐎ষ্টি হয়ে যায়।
গণমাধ্যম অবশ্যই জন-আবেগ, জন-আকাঙ্ক্ষা, জনরুচির সঙ্গে চলবে। এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু গণমাধ্যমের দায়িত্ব আরও একটু বেশি। গণমাধ্যম জন-আবেগ, জন-আকাঙ্ক্ষা, জনরুচি তৈরি করবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় কোনো সুন্দরী চিত্রনায়িকার🦋 খোলামেলা ছবি ছাপা হলে কাটতি বাড়বে। এটা জেনেও কিন্তু কোনো পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় তেমন ছবি ছাপে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিরো আলমকে নিয়ে অনেক মাতামাতি হলেও মূলধারার গণমাধ্যমে কিন্তু তার তেমন ঠাঁই মেলেনি। গণমাধ্যম গ্রামীণ বাউল মমতাজকে খুঁজে বের করে শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রইং রুমে পৌঁছে দেয়। অনেক মানুষ এক হয়ে কোনো অযৌক্তিক দাবি তুলে ধরলেও গণমাধ্যম কিন্তু তাতে হাওয়া দেয় না। এখানেই সম্পাদকীয় বিবেচনার প্রশ্ন। ‘প্রতিবন্ধী শিশু বাবা-মায়ের পাপের ফসল’ এমন অসংবেদনশীল সংলাপের কারণে কিন্তু এবারের ঈদের নাটক ‘ঘটনা সত্য’ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নির্মাতারা। একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যম জনমতের পেছনে দৌড়াবে না, বরং জনমত তৈরি করবে। নানা প্রচার-প্রচারণা,ꦿ বিধিনিষেধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো মাস্ক ব্যবহার করছে না। যেহেতু বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে না, তাই গণমাধ্যমেরও মাস্কের বিপক্ষেই অবস্থান নেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমই কিন্তু বারবার মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমেরই জনমত তৈরির দায়িত্ব। তবে ইদানীং জনমত গঠনের ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্রুত ও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ইস্যুতে জনমত তৈরি করতে পারে। প্রবল জনমতের চাপে গণমাধ্যমও তখন সেই ইস্যুতে সোচ্চার হয়। সাধারণভাবে কম সংবাদ মূল্যের ঘটনাও অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে গণমাধ্যমের অনেক বেশি পরিসর দখল করে নেয়। ইদানীং এমন প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, ফেসবুকে ভাইরাল হলেই কোনো ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, বিচার হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের সহযোগী হিসেবেই কাজ করে। তবে মনে রাখতে হবে সমাজের, মানুষের সমস্যা তুলে ধরার, কোনো ঘটনার বিচার-বিবেচনার, কাভারেজের লাগামটা যেন গণমাধ্যমের হাতেই থাকে। লাগামটা যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাতে চলে গেলে সমাজের শৃঙ🎉্খলা ভেঙে পড়বে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তো আছেই, স্বাধীন সাংবাদিকতার পথেও অনেক বাধা। সরকারি, বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা হুমকি আছ✅ে, আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বাধা। এত বাধার পরও গণমাধ্যম নিজেদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দায়িত্বটা পুরোপুরি পালন করতে পারছে, তেমন দাবি করব না। তবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহের কাজটা গণমাধ্যমকে করে যেতে হবে। তথ্য হলো খাবার আর গুজব হলো ভেজাল খাবার। গণমাধ্যম যদি গণমানুষের খাবারের মানে তথ্যের চাহিদা মেটাতে না পারে, তখনই তারা ভেজালের মানে গুজবের পেছনে ছুটবে। গণমাধ্যম হয়ে উঠুক গণমানুষের সত্যিকারের কণ্ঠ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট