এবারের ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন কেমন বিশ্ববিদ্যালয় তারা চায়? আরেকটি প্রশ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম নিয়ে। আমরা যখন খাতা দেখছিলাম তখন খুবই ভালো লাগছিলো যে শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটির বিশ্লেষণ পড়ে। এটাই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সৌন্দর্য্য। প্রত꧋িবছর জগন্নাথ হলের মাঠে সরস্বতি পূজায় বিভিন্ন বিভাগের প্রতিমা দেখেই বোঝা যায় এটি কোন বিভাগের প্রতিমা। সেরকমই বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলো। কিন্তু এরইমধ্যে আগামী ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিট না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর পাশাপামি আরেকটি সিদ্ধান্তের কথাও প্রশাসনিকভাবে জানা গেছে, আর তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৮৫টির মতো আসনও কমানো হবে।
তবে ঘ ইউনিট নিয়ে ঝোলাঝুলি চলছিল ২০২০ থেকেই। ডিনস কমিটিতে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ১৬টি বিভাগের শিক্ষকরাও তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। সেই ঝড় তখন কমে গেলেও এবার প্রশাসন বেশ অনড়। ২০২০-২১ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পাঁচটি ইউনিটের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। এগুলো ছিলো বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য ক, কলা বিষয়গুলোর জন্য খ, ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলোর জন্য গ, বিভাগ পরিবর্তনের জন্য ঘ💯 এবং চারুকলার বিষয়গুলোর জন্য চ ইউনিট। তবে সামনের সেশন থেকে ঘ ইউনিট বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ইউনিটের পরিবর্তে ক, খ, গ এবং চ-এই চারটি ইউনিটের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা এবং শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে।
ঘ ইউনিট না রাখার পেছনে যুক্তি হ🐻িসেবে জানা গেছে, প্রশাসন নাকি পরীক্ষার সংখ্যা এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধরেই যদি নিই যে শিক্ষার্থীদের কষ্টই এখানে প্রধানꦺ এবং সেটি কমানোই মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কোথায়? অন্য সব ইউনিটে পরীক্ষা দিতে আসতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হয় না? গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে। তাহলে কেন সেটি বন্ধ হবে?
আরও যুত্তি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, ‘ঘ’ ইউনিট বাতিল হলেও ‘ক’ ইউ🍰নিটে পরীক্ষা দিয়েও কেউ বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবেন। নিশ্চয়ই তা পারবেন। কিন্তু আমি জানতে চাই, একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে হলেও কেন ‘ক’ কিংবা ‘খ’ ইউনিটেই শুধু পরীক্ষা দিতে হবে? কিংবা রসায়ন, পদার্থ, গণিতে পাস করেও তাকে কেন সামাজিক অনুষদভুক্ত বিভাগে যেতে হবে? এগুলো কোনোভাবেই মাথায় ঢুকছে না। কেন তাকে তার আগ্রহ এবং সেই বিষয়ে তাঁর দখল এবং জানাশোনা পরখ করার সুযোগ দেওয়া হবে না? বরং দুই বছর থে༒কে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, চিন্তাকে সম্মান জানিয়ে এবং তাদের যোগ্যতা আরও যাচাই করার জন্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এমসিকিউয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, জানাশোনা এবং অনুবাদ সক্ষমতা মূল্যায়নের জন্য আলাদাভাবে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল।
তবে এই সিদ্ধান্তটি প্রথমে এসেছে ডিনস কমিটি থেকে, যেটি আমি আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু এখন আবারও এসেছে ভর্তি পরীক্ষা কমিটি থেকে। কিন্তু এগুলো কি আসলেই শিক্ষকদের মতামত? নিশ্চিতভাবেই নয়। ডিনদেরও মনে রাখতে হবে, উনারা অনুষদের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ডিন। তাহলে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটি হতে হবে সেই অনুষদের সব কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক🍸্ষকদের সিদ্ধান্ত। তাহলে প্রশ্ন আসে, সংশ্লিষ্ট অনুষদের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা না করে কীভাবে ডিনরা উনাদের ব্যক্তিগত মতামতকে সিদ্ধান্ত আকারে হাজির করলেন? এবং বর্তমানে যে ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত হিসেবে এটি হাজির হয়েছে এটি কি আসলেই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত? এক অনুষদের কাছে আরেক অনুষদ কম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু নিশ্চয়ই কোন অনুষদকে না রাখার পক্ষে তো যাওয়ার কথা নয়। যদিও বলা হয়েছে, একাডেমিক কাউন্সিলে এটি চূড়ান্ত হবে। কিন্তু সেখানেও যে সিদ্ধান্তের খুব বেশি নড়চড় হবে সেটি স্পষ্টতই বোঝা যায়। কারণ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি জারি আছে , সেখানে যুক্তিতর্কের চেয়ে প্রাধꦑান্য পায় ক্ষমতা, আনুগত্য এবং তোষামোদ। তাই সেখানে আসলে এটির পক্ষে কথা বলা শিক্ষকদের অভাব হয়তো হবেনা।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বয়স পঞ্চাশ। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা হয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীর সংখ꧋্যা ছয় হাজেররও বেশি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। ১৬টি বিভাগ নিয়ে এই অনুষদ এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, অসমতা, বৈষম্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসনসহ সবকিছুকে নিয়ে প্রতিনিয়তই কাজ করছে এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করছে। তাই এসব বিষয়ের প্রতি শিক্♉ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এই অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগও রয়েছে পুরোনো এবং দু–একটি বিভাগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚ𒀱ᩚᩚᩚষদই তার কাছে সমগুরুত্ব পাওয়ার কথা। এর বিপরীতে গিয়ে কিছু অনুষদগুলোকে সংকুচিত করে অন্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করা বিশ্ববিদালয়ের ধারণার সঙ্গে একেবারেই যায় না। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষদকে ভর্তি পরীক্ষার পরিসর থেকে ছেটে ফেলার সিদ্ধান্ত শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রক্ষণশীল’ মনোভাবকেই সামনে আনছে। গোঁজামিল নয়, বরং এসব অনুষদের বিভাগগুলোর কাজ ও চিন্তার বৈচিত্র্যের ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষা আলাদা নেওয়ার বিষয়টি বহাল রাখতে হবে। এই অনুষদকে কলা ও বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে নয়, তাদের নিজস্ব অনুষদেই সবকিছু পরিচালনা করতে দিতে হবে এবং এর মধ্য দিয়েই শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়টি বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তার পরিসরটি আরও মজবুত করবে।
যুক্তি দেয়া হয়েছে যে এই পরীক্ষার এমসিকিউ প্রশ্নের সাথে ‘খ’ অনুষদের প্রশ্নের মিল থাকে। কিন্তু 'ঘ' ইউনিটের বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রশ্ন সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় প্রেক্ষিতের আলোকে করা হয়। অন্তত গত দুটো সেশনের প্রশ্ন দেখলেই সেটি যে কেউই বুঝতে পারবে। উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের জন্য সকল পরীক্ষার্থীকেই বাংলা ও ইংরেজি বাধ্যতামূলকভাবে পড়তেই হয়। কিন্তু পৌরনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এগুলো সরাসরি সামাজিক বিজ্ঞানের অধীত বিষয়। তাই কীভাবে ঘ অনুষদ বাদের প্রশ্ন আসে?
শুধুমাত্র ঘ অনুষদের পরীক্ষার দিন কমিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানোর চিন্তা মোটেও যে শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে নয়, সেটির উদ্দেশ্য যে অন্য জায়গায় এবং তা যে শিক্ষকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, তা না বোঝার কো꧒ন সুযোগ নেই। তাই এটি পূণঃবিবেচনার আহ্বান জানাই।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়