নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রয়োজনে একটা সার্চ কমিটি তৈরির লক্ষ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপ শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলভুক্ত জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ সংলাপে অংশ নিয়েছে। সাম🦩নের দিনগুলোতে নিবন্ধিত মোট ৩৪টি দলের মধ্যে আরও কয়েকটি দল এতে অংশ নেবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটভুক্ত কয়েকটি দল এবং বিএনপির আরেক মিত্র ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও সংলাপে যাবে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও, একটা আশঙ্কা পর্যবেক্ষকদের একাংশ থেকে ইতিমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতির এবারের সংলাপটি ব্যর্থ হতে চলেছে। তাদের যুক্তি হলো, বিএনপি চলমান সংলাপে অংশগ্রহণ করছে না। একই সঙ্গে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি ও বাসদের নিবন্ধিত অংশটিও জানিয়ে দিয়েছে যে তারাও সংলাপে যাচ্ছে না। তাই তারা মনে করেন—দেশের সব স্তরেᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚ𒀱ᩚᩚᩚর মানুষের কাছে রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিএনপি অন্যতম প্রধান র♍াজনৈতিক দল। দেশের সব সেক্টরকে আপাত আওয়ামী লীগময় মনে হলেও দেশে সরকারবিরোধী লোকের সংখ্যা কম নয়; আর এদের কাছে বিএনপিই এখনো প🐓্রথম পছন্দের দল। অতএব চলমান সংলাপে বিএনপির অংশগ্রহণ করা বা না-করা জনমতের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলার সুযোগ নেই।
তবে বিএনপি যে যুক্তি দেখিয়ে সংলাপ বর্জন করছে, তা কি বাস্তবসম্মত? গত ২৯ ডিসেম্বর দলটির পাঠানো প্রেস রিলিজের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংবাদপত্র যে খবর প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে: ‘বিএনপির স্থায়ী কমিটি বিশ্বা꧂স করে, নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কোনো নির্বাচন কমিশনই অনুষ্ঠান করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছেন পরিবর্তন করার ক্ষমতা তাঁর নেই। সে কারণে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ কোনো ইতিবাচক ফল আনতে পারবে না। বিএনপি অর্থহীন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করবে না।’ অর্থাৎ বিএনপি বলতে চাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক, একটা রাজনৈতিক সরকারকে ক্ষমতায় রেখে দেশে কোনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আর যেহেতু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকালে তাদের আকাঙ্ক্ষিত ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা রাখেন না, তাই এ সংলাপ ‘অর্থহীন’।
বিএনপির এ অবস্থানটা বাস্তবসম্মত হতো, যদি নির্বাচনকালে একটা ‘নির্দলীয়’ সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য থাকত। ১৯৯১ সালে জাতীয় ঐকমত্যের কারণেই এ ধরনের একটা সরকারের অধীনে জ♋াতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ♑বং এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনকালে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার বিধানটি যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ওই জাতীয় ঐকমত্য কি বহাল ছিল?
এ নিয়ে খুব বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে ২০০১ সালের বিচারপতি লতি🌱ফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আস্থা পুরোপুরি হারিয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালের নির্বাচনকে ঘিরে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি থেকে শুরু করে বিএনপি-দলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানাতে যেসব কাণ্ড করেছিল, তা এ ধরনের সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ শুধু নয়, দেশের সিংহভাগ মানুষের চূড়ান্ত অনাস্থা তৈরি করেছিল। আর বিএনপির এসব কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিয়ে দেশে যে ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের নেতৃত্বে তখন ১/১১ ঘটেছিল—যার বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ-বিদ্বেষ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেয়ে কম ছিল না বরং একটু বেশিই ছিল, তা কি ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়নি?
এটা ঠিক, আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটা এককভাবে, অর্থাৎ বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে, ২০১১ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার এটা করেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে, যে রায়ে এ ধরনের সরকারকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে বℱিএনপি ওই বিধানটি ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনের নামে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু তাদের ওই সব উদ্যোগই ব্𝓀যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনকালে কথিত নির্দলীয় সরকার বসানোর ইস্যুটা মাঠেও ফয়সালা হয়ে গেছে। আর তা ফয়সালা হয়েছিল বলেই বিএনপি নেতারা ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন—২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে তারা শুধু ভুল করেননি, বিএনপিকেও এর কাফফারা দিতে হয়েছে।
উল্লিখিত ২৯ ডিসেম্বরের খবরে আরও বলা হয়েছে: ‘নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে শুরু হওয়া সংলাপে অংশ নেওয়াকে বিএনপি সময় নষ্💎ট বলে মনে করছে।’ তাই এই সংলাপে না গিয়ে বরং সরকার পতনের আন্দোলনে মনোযোগ দেওয়াকেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। অর্থাৎ শুধু রাষ্ট্রপতির সংলাপ বর্জন নয়, বিএনপি ২০১৪ সালের আগে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কি বৈধ-অবৈধভাবে দেড় দশকের বেশি দেশ শাসনকারী দলটিকে সে সুযোগ দেবে?
প্রশ্নটা এ কারণে তোলা হলো যে, গত আট বছরে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। করো꧂নার কারণে ২০২০ সালে তা ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছর আবার ৭ শতাংশকে ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রায় সবাই বলছেন। অর্থনীতির এ তেজি ভাবের ইতিবাচক প্রভাব জনজীবনে পড়তে বাধ্য। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০১৪ সালেও দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, লোডশেডিং ছিল সব স্তরের মানুষের প্রায় নিত্যসঙ্গী। কিন্তু বর্তমানে একদিকে যেমন দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে, আরেক দিকে তেমনি অত্যাবশ্যকীয় এ সেবার সরবরাহও প্রায় নিরবচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর টানেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প♓্ল্যান্টের মতো মেগা প্রকল্পগুলো ছিল পুরোপুরিই স্বপ্ন, কিন্তু এ বছর এই সব কটি প্রকল্প বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠছে; একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এসব প্রকল্পজাত পরিষেবা। জনগণ কোন দুঃখে বিএনপির কথা শুনে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে নিজেদের এসব পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করবে?
তাছাড়া বিএনপি ও তার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কাঠামো ও শক্তি ২০🧸১৪ সালে যা ছিল, তা কি এখনো অক্ষুণ্ন আছে? বলা যায়, গ🐼ত আট বছরে এ দুটো দল শুধু সাংগঠনিক শক্তিই হারায়নি, তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব দৃশ্যপট থেকে হয় হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যাওয়ার পথে আছে। দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপির, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাও এ সময়ে চরমে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় তাদের ডাকে সরকার হটাতে মাঠে নামবে কে?
বর্তমান সরকারের আমলে যে দুটো নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছিল, তারা তাদের ম্যান্ডেট কাজে লাগাতে পারেনি, এটা সত্য। এমনকি প্রশাসক বা ক্রাইসিস ম্যনেজার হিসেবে কমিশনগুলোর অনেক সদস্য তাঁদের পেশাগত জীবনে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তাঁরা নির্বাচন ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে তার সঙ্গেও সুবিচার করতে পারেননি। ফলে এ সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মান নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্রদের অসন্তোষ ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গত ৫০ বছরে কোনো সরকার উপহার দিতে পেরেছি কি? আগেই বলা হয়েছে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা এ♛খন প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে নির্বাচনগুলোও অন্তত পরাজিত পক্ষের কাছ থেকে পাস মার্ক পায়নি। এখনো সুযোগ পেলেই বিএনপি নেতারা ২০০৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে যেভাবে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন তা কি কারও অজানা? তাছাড়া ১/১১-এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর গণতন্ত্রপ্রেমিক কোনো দল বা মানুষই খাল কেটে কুমির আনতে চাইবে না।
গণতন্ত্রের প্রশিক্ষক দাবিদার যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবিদার ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিতর্কসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটা জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা দেশে শুধু একটা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকলেই 𒅌হয় না, এ জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোরও শক্ত জনভিত্তি থাকতে হয়। তাই হটকারী চিন্তা বাদ দিয়ে বিএনপি যদি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার মাধ্যমে নিজের জনভিত্তিকে মজবুত করায় মনোযোগ দেয় সেটাই বরং একদিকে জনগণের ভোটাধিকারের অবাধ চর্চার পরিবেশ তৈরি করবে, আরেক দিকে নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট