বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছে কয়েকটি তথ্যচিত্র যেখানে বক্তব্য, বিশ্লেষণ এবং ঐতিহাসিক তথ্য প্রদান করা হয়ে▨ছে নান্দনিকভাবে আꦐকর্ষণীয় নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রগুলিতে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের যে দৃশ্যসমূহ পরিচালকরা তথ্যচিত্রগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তা দর্শককে কখনো আঘাত করেছে, তাদের জন্য তৈরি করেছে অস্বস্তি, আবার কখনো তাদের দেশপ্রেমের অনুভূতি সংহত করেছে।
জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মিত হয়েছিল সাদাকালোয়। দৃশ্যগুলোয় ছিল এক ধরনের অনুজ্জ্বল আর বিবর্ণ ভাব যা দর্শকের জন্য তৈরি করেছিল বিষাদের অনুভূতি। দেখানো হয় পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে চলেছে ভারতের পথে। পা ডুবে যায় অমন পুরু কাদায় ভরা পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে তারা সেই আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে যেখানে গুলি করে তাদের হত্যা করা হবে না। এমন নিরীহ মানুষদের কেন প্রাণভয়ে নিজ দেশ ছেড়ে পালাতে হবে? কেন তাদের হত্যা করবে ꦏআধুনিক অস্ত্র ব্যবহারকারী শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী? ছবিতে বারবার দেখানো হয় বাংলাদেশসহ 𓃲অন্যান্য দেশে গণহত্যায় নিহত মানুষের মৃতদেহের স্থিরচিত্র। কখনো শোনা যায় গুলির শব্দ, সেই শব্দের পরই দেখা যায় শরণার্থী শিবিরের এক শিশু, শোনা যায় কান্নার শব্দ। তথ্যচিত্রটিতে ব্যবহৃত দুটি মর্মস্পর্শী দৃশ্য দর্শকের মনে তীব্র আঘাত হানে। একটিতে দেখা যায়, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না এমন অশীতিপর এক বৃদ্ধা বাঁকা হয়েই কর্দমাক্ত পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছেন প্রাণে বাঁচার জন্য। এই দৃশ্যটিই স্পষ্ট করে কতোটা নির্মমতা তখন দেখেছিল বাংলাদেশের মানুষ যে এমন একজন বৃদ্ধাও প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বৃদ্ধা শুধু একটি কথাই বলেন: “সব শেষ, কিছুই আর নেই, কেউই আর নেই।”
অতি-দুর্বল আর ক্লান্ত এই বৃদ্ধা কথা বলতে পারলেও তথ্যচিত্রে দেখা যায় এক কিশোরীকে যাকে নাম জিজ্ঞাসা করা হলেও সে শুধুই তাকিয়ে থাকে, তার ঠোঁট একবার নড়লেও সে কোনো কথা বলতে পারে না। ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখে বাংলাদেশে সেই সময় অনেকেই কি সেই কিশোরীটির মতো নির্বাক হয়ে যায়নি? তথ্যচিত্রে বলা হয়, এই কিশোরীর মাধ্যমেই যেন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ আর বেদনা। জহির রায়হানের আরেকটি তথ্যচিত্র ‘আ স্টেট ইজ বর্ꦿনে’র নির্মাণশৈলীতে ছিল অভিনবত্ব। ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর মতো এই তথ্যচিত্রেও নেপথ্যে আলমগীর কবিরের কন্ঠে শোনা যায় বিভিন্ন বর্ণনা আর বক্তব্য। ছবিতে এক একটি সন ভেসে আসে, শোনা যায় সেই বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন স্থিরচিত্র, কখনো ক্যামেরা দ্রুত এগিয়ে যায় কোনো স্থির ছবির উপর, আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন দৃশ্যের মন্তাজ, কখনো দেখা যায় নেগেটিভ দৃশ্য। এমন বিভিন্ন কৌশল মান বাড়িয়ে তুলেছিল চলচ্চিত্র-ভাষার। তথ্যচিত্রে দেখানো হয় চার জাতীয় নেতার বিভিন্ন ক্লোজ-আপ শট। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নতুন দেশের রূপ কেমন হবে, কিভাবে জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা হবে, নতুন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে চার জাতীয় নেতার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও শোনা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র চালনার এবং যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ কিভাবে এক একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হচ্ছে আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ তথ্যচিত্রে তার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পরিচালক ভানিয়া কিউলি আট দিন দুই নম্বর সেক্টরে কাটিয়ে সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফসহ আরও বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, এবং যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টেলিভিশনের প্রযোজনায় নির্মাণ করেছিলেন ‘মেজর খালেদ’স ওয়ার’ নামে একটি তথ্যচিত্র। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা যায় এই তথ্যচিত্রেও। মেজর খালেদ মোশাররফ ধীরস্থিরভাবে জানান যুদ্ধের নানা দিকের কথা। তিনি জানান বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, কিন্তু তাদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে তারা এখন মরিয়া। পাকিস্তানিরা তাদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই দেশের মানুষ তাদের মাটি শত্রুমুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরী আর ক্যাপ্টেন মেহবুবুর রহমান এই দুইজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাকেও এই তথ্যচিত্রে কথা বলতে দেখা যায়। আরও দেখা যায়, দুই নম্বর সেক্টরের আরও দু’জন বাঙালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন ফজলুল কবীরকে। কুমিল্লা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করার জন্য ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের ছোট একটি খাল পেরিয়ে ধানক্ষেতের মধ্যে থাকা বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করার দৃশ্যও আছে এই তথ্যচিত্রে। তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ইশরাক, হুমায়ুন কবির, হাবিবুল আলম, শহীদুল্লাহ খান বাদলকে দেখা যায় তথ্যচিত্রে। দেখা যায় গ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের। একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিয়ে সালেক চৌধুরী বলেন ছেলেটির মা-বাবাকে হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা, আর ছেলেটি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যোগ দিয়েছে মুক্তিফৌজে। পরিচালক ভানিয়া কিউলির এক প্রশ্নের জবাবে সালেক চৌধুরী জানান তার নিজের পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন তা তার জানা নেই। খালেদ মোশাররফ, সালেক চৌধুরী, মেহবুবুর রহমান এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা💙 স্বাধীনতার পর বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। অকালে তারা মারা গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বলা তাদের কথা থাকার কারণে এই তথ্যচিত্রটির গুরুত্ব বেড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের কমান্ডাꦍর কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেখানো হয়েছিল ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ। আর সুনির্মিত আরেকটি তথ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’-এ দেখা যায় একই সেক্টরের একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য গান গেয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামক একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্যরা। মার্কিন সাংবাদিক লিয়ার লেভিন এই শিল্পীদের কাজের বিভিন্ন মুহূর্ত ধারণ করেছিলেন। অনেক বছর পর, ১৯৯৫ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ সেই দৃশ্যগুলো পাওয়ার পর তৈরি করেছিলেন ‘মুক্তির গান।’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে গিয়ে যখন তরুণ সংগীতশিল্পীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা আর মনোবল জাগানো সংগীত পরিবেশন করছিলেন, সেই সংগীত শুনে তাদের সামনে পাশে অস্ত্র রেখে সাধারণ পোশাক পরে বসে থাকা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত হয়ে ওঠার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায় এই তথ্যচিত্রে। ভারতীয় চলচ্চিত্রকার শুখদেবের ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ তথ্যচিত্রেও আছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দুর্লভ দৃশ্য। পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে পূর্ব বাংলার মানুষদের দীর্ঘ দিন যে শোষণের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া একটি বক্তব্য দেখা যায় তথ্যচিত্রে যেখানে দৃপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন এই শোষণ আর সহ্য করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক আর বর্বর গণহত্যা, বাঙালি শরণার্থীদের তীব্র দুর্দশা, বাঙালিদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রভৃতি বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মাদার তেরেসা, মার্কিন সিনেটর এডোয়ার্ড কেনেডি, বৃটিশ এমপি জন স্টোনহাউস, বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আঁন্দ্রে মালরো, সুইডেনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক গুনার মিরডাল, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান আর আলমগীর কবির, পাবনার জেলা প্রশাসকের পদে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া নুরুল কাদের খান, মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের কমান্ডার তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখের বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে।
🐻স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রগুলি কতোটা পরিচিত নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছে, বর্তমান সময়ের সাধারণ মানুষদের কাছে? এই সময়ের বহু কমবয়সী কি দেখেছে এই তথ্যচিত্রগুলি যেখানে আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য, এবং যেখানে আমাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তিকে কথা বলতে দেখা যায়? কেবল ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর এলেই গণমাধ্যমে এই তথ্যচিত্রগুলি দেখালে তা নাগরিকদের ইতিহাস-সচেতন করতে, আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুধাবন আর ধারণ করতে সাহায্য করবে না। এই তথ্যচিত্রগুলি প্রচার করতে হবে নিয়মিতভাবে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষরাও যেন এই তথ্যচিত্রগুলি নিয়মিত দেখতে পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তির প্রসারের কারণে আজ দেশের মানুষ গণমাধ্যমে, সোশাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে সহজে এবং নিয়মিত দেখছে নানা উপাদান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রগুলি দেখার জন্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কী কী ঘটেছিল তা জানার এবং বোঝার জন্য কি বর্তমান সময়ে দেশের নাগরিকদের যথেষ্ট উৎসাহিত করা হচ্ছে? পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রের এই প্রশ্নগুলি সম্পর্কে ভাবা প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।