শিল্পের সিন্দুক

একটি কবিতার জন্মের এক শ বছর

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২২, ০৩:৩০ পিএম

ক্ষুদে বন্ধুরা, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম তো তোমাদের সবারই জানা। তোমরা নিশ্চয়ই এটাও জানো যে তিনি সবার কাছে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামেই বেশি পরিচিত। কিন্তু তোমরা কি বলতে পার তাঁর নামের আগে কেন এই ‘বিদ্রোহী’ ൩উপাধিটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে? তিনি খুব প্রতিবাদী, বিপ্লবী ও বিদ্রোহী চরিত্রের কবি ছিলেন এটা সত্য, কিন্তু কবির এই ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটুকু আসলে তাঁর একটি বিশ্ববিখ্যাত কবিতার সূত্রে পাওয়া। তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে আন্দাজ করতে পেরেছ আমি কোন কবিতাটির কথ🎃া বলছি। হ্যাঁ, সেটি হচ্ছে তাঁর লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে বেশিবার পড়া এবং সবচেয়ে বেশি আবৃত্তি করা কবিতা ‘বিদ্রোহী’,যেটি শুরু হয় নিচের এই বহুপরিচিত লাইন তিনটি দিয়ে, যার সঙ্গে তোমাদেরও সবার পরিচয় রয়েছে বলেই আমার দৃঢ়বিশ্বাস।


বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

তোম꧃রা জেনে খুশি হবে, এই বছর অর্থাৎ ২০২২ সালেই এই কবিতাটি প্রকাশের এক শ বছর পূর্ণ হয়েছে।কবিতাটি নজরুল রচনা করেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের একেবারে শেষ দিকে, যখন তিনি কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের এক কামরার একটি ঘরে, ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমর꧙েড মুজফফর আহমদের সঙ্গে থাকতেন, যাঁকে সবাই ভক্তিভরে কাকাবাবু বলে ডাকে। তো, এই কবিতাটির জন্ম ও প্রথম প্রকাশ বিষয়ে তিনি তাঁর লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ (১৯৬৫)বইয়ে নিচের এই কথাগুলো লিখেছেন।

‍“তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পুবꦕ দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‍‍ ‘বিদ্রোহী‍‍’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‍‍‘বিদ্রোহী‍‍’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।‍‍” তিনি সেই বইয়ে আরও জানিয়েছেন, ‍‍ “আমার মনে হয়, নজরুল শেষরাত্রে কবিতাটি লিখেছিল, তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।…এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথা🐻র সঙ্গে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।”

কবিতাটিকে ঘিরে এরপর রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়, কোন পত্রিকার সম্পাদক এটি আগে ছাপতে পারেন, তা নিয়ে। এটি কবির কাছ থেকে প্রথমে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক সাহেব। তবে তাঁর ছাপতে একটু দেরি হওয়ার সুযোগে কবিতাটি প্রথম ছাপানোর গৌরব অর্জন করেন ‘বিজলী’ পত্রিকার সম্পাদক, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য।১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি কবিতাটি তাঁর পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সেটিকে নিয়ে এমনই আগ্রহ আর কৌতূহলের জন্ম হয় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে, সেদিন পত্রিকাটিকে দুবার করে ছাপতে হয়েছিল তাঁকে, এবং কমরেড মুজফফরের আহমদের ধারণা, সেই দিন অন্তত দুই লাখ মানুষ কবিতাটি পাঠ করেছিল। এরপর এই একই কবিতা ‘মোসলেম ভারত’সহ আরও একাধিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল,পাঠকের কাছে এমনই চাহিদা ছিল তার।কবিতাটি আসলেই একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন ভাবনার দুঃসাহসী রচনা ছিল, যা পড়ামাত্রই গায়ে যেন আগুন ধরে যেত সবার; জগতের যত অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, বিক্ষোভে বিদ্রোহী হয়ে উঠত মন।‘বিদ্রোহী’ কবিতার আঙ্গিকটিও ছিল বেশ অভিনব। ১৪টি স্তবকে বিভক্ত এই কবিতার মোট চরণসংখ্যা ১৪১। আর তাꦡতে শুধু ‘আমি’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছিল মোট ১৪৫ বার।কবিতাটিতে নজরুল হিন্দু,মুসলিম এমনকি গ্রিক পুরাণের নানান অনুষঙ্গ, আখ্যান, শব্দ,উপমা ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন খুবই বুদ্ধিমত্তা ও সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে।এছাড়া এই কবিতার ছন্দটিও ছিল বেশ অভিনব, যা নজরুলের একান্ত নিজেরই সৃষ্টি।

সবচেয়ে মজার কথা, কবিতাটি ছাপা হওয়ার কয়েক দিন পর ‘বিজলী’ পত্রিকার কিছু কপি নিয়ে তিনি সোজা চলে যান জোড়াসাঁকোতে কবিগুরু রবীন্দ্রনা🍨থের বাড়িতে। কথিত আছে, সেখানে গিয়ে তিনি উঠোন থেকে চিৎকার করে বলতে থাকেন, “গুরুজী, গুরুজী, আমি আপনাকে খুন করতে এসেছি।” রবীন্দ্রনাথ হাসিমুখে এর কারণ জানতে চাইলে নজরুল পত্রিকার পাতা থেকে তাঁকে এ💝ই কবিতাটি পড়ে শোনান। কবিতা শুনে রবীন্দ্রনাথ তো রীতিমতো স্তম্ভিত, এত ভালো কবিতা লিখেছে মাত্র বাইশ বছরের ছেলে নজরুল! তিনি তখন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হ্যাঁরে, নজরুল একমাত্র তুই-ই পারবি আমাকে খুন করতে। তুই একদিন বিশ্ববিখ্যাত হবি।” সেই থেকে তাঁদের মধ্যে যে অকৃত্রিম স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তার কোনো তুলনা হয় না।সেবছরই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে আর-একটি জ্বালাময়ী কবিতা লেখা ও প্রকাশের অপরাধে ব্রিটিশ সরকার নজরুলকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় বন্দি করে রাখে। এই খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গীতিনাট্য ‘বসন্ত’, নজরুলের নামে উৎসর্গ করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন তাঁর কাছে। সেটি পাঠ করে নজরুল ভুলে থাকতেন বন্দিত্বের বেদনা। তো একদিন,জেলের বন্দিদের ওপর ব্রিটিশদের অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল আমৃত্যু অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে থাকতে নজরুলের শরীর খারাপ হয়ে প্রায় মৃত্যুর শঙ্কা দেখা দিলে অনেকেই তাঁকে অনশন ত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু তিনি কারও কথাই শুনতে রাজি হন না। সেই সময়ে খোদ রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন এই বলে যে, Give up hunger strike, our literature claims you.(অনশন ত্যাগ করো, আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়।) এখানে আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি, নজরুল বিখ্যাত ‘সঞ্চিতা’ কাব্যসংকলনটি তাঁর গুরুজী রবীন্দ্রনাথকেই উৎসর্গ করেছিলেন।

শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রশংসা করেছেন আরও অনেক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, যাঁদের মধ্যে অন্যতম, সেই সময়ের বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসু। তিনি বলেছিলেন, “মনে হলো এমন কিছু আগে কখনো পড়িনি ।” পরে তিনি আরও  লিখেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যে বিশ শতকে রবীন্দ্রপ্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।” অনেক গুণীজন তাঁর এই কবিতাটিকে আমেরিকার জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এর বিখ্যাত কবিতা, ‘দা সং অব মাইসেল্ফ’ এর সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সে যাক, তোমরা জানো 🅠কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কথা বলার কিংবা কথা বোঝার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তোমরা শুনে অবাক হবে, সেই অবস্থাতেও তিনি তাঁর এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে ঠিকই চিনতে পারতেন। এই প্রসঙ্গে কবির নাতনি খিলখিল কাজী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‍‍“সেই সময় আমার বাবার তো অল্পবয়স ছিল। আমরা যখন জন্মালাম, দাদুর তখন অনেকটা বয়স হয়ে গেছে। আমার বাবা কাজী সব্যসাচী দাদুর সামনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রায়ই আবৃত্তি করতেন। তখন দেখেছি দাদুকে ভীষণভাবে উদ্বেলিত হতে, ‘বিদ্রোহী’ শুনলেই উনি চোখটা যেন কেমন করতেন, মাথায় হাত বুলাতেন। এখনো পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার হচ্ছে, দাদু যদি কথা বলতে পারতেন, তাহলে কোথাও গিয়ে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, প্রতিবাদ করবেন, এই অনুভবটা আমরা দাদুর চোখেমুখে দেখতে পেতাম।”

নজরুলের এই অসাধারণ কবিতাটি সে বছরই অক্টোবর মাসে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’তে স্থান পায়। এই বইটিও এতটাই জনপ্রিয় হয় যে কিছুদিনের মধ্যেই এর বেশ কয়েকটি সংস্করণ বের হয়। বইটির এমন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা দেখে ব্রিটিশ শাসকেরা রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়, তারা তড়িঘড়ি 🌟করে বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। তো, এ মাসেই এই বইটিরও এক শ বছর পূর্ণ হবে। আশা করা যায়, তখন এটিকে নিয়েও দেশে-বিদেশে উদ্‌যাপনের তোড়জোড় শুরু হবে। তোমরা তার আগেই বইটি সংগ্রহ করে তার কবিতাগুলো, বিশেষ করে এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আরও একবার মন দিয়ে পড়ে নেবে, এই প্রত্যাশা রেখে এবং কবিতাটির বহুবিখ্যাত শেষ লাইন কটি উদ্ধৃত করে আমার লেখাটির ইতি টানছি এখানে।

“আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”